ফুয়ানকা Fuanka
By শাপলা জাকিয়া
()
About this ebook
আমি নীলা, গতকাল মারা গিয়েছিলাম। মারা যাবার ঘন্টাখানেক পর আবার বেঁচে উঠেছি। বাড়ির লোকজন এখন ডাক্তারকে গাল- মন্দ করছেন। বেচারা ডাক্তার অল্পবয়সী একজন সুদর্শন পুরুষ। সদ্য ডাক্তারি পাস করে এই এলাকায় একটা চেম্বার খুলে বসেছেন। ক্যারিয়ারের শুরুতেই এহেন বিপত্তিতে পড়বেন দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। এলাকার কয়েকজন ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, এই ডাক্তারের কাছে রোগী নিয়ে তারা কিছুতেই যাবেন না। জ্যান্ত মানুষকে মরা বলে দিল, এ কেমন ডাক্তার!
হয়েছে কি, গতকাল দুপুরে কলেজ ছিল না। ছুটির দিন বলে আমি একটু ভাত ঘুমের চেষ্টা করেছিলাম। সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি হওয়ায় ওয়েদারটা ঠান্ডা। পর্দা টেনে ঘরটাকে আরও ছায়া ছায়া করে ফেললাম। তারপর ফুল স্প্রিডে ফ্যান ছেড়ে একটা পাতলা সুতি চাদর গায়ের ওপর টেনে দিয়ে শুয়ে পড়লাম, হাতে বই। ভূতের গল্প সমগ্র। একটা গল্প সবে শুরু করেছি হঠাৎ চেহস্ট পেইন শুরু হলো। আমার একুশ বছরের জীবনে এরকম ব্যাথা এর আগেও হয়েছে। আব্বা আমাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ইসিজিও করিয়েছেন। রিপোর্ট নরমাল ছিল। ডাক্তার কিছু গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দিয়ে বিদায় করেছিলেন।
কাল ব্যাথাটা টের পেয়ে প্রথমে বিরক্ত লেগেছিল। আয়েশ করে একটু শুয়েছিলাম, উঠে ওষুধ খেতে হবে ভাবতেই ভালো লাগছিল না। কিন্তু উঠতে গিয়ে অনুভব করলাম, পেইনটা এতো বেশি যে নড়তে পারছি না। মনে হচ্ছে হাজারটা সুঁই কেউ ক্রমাগত পুশ করছে আমার হৃৎপিন্ডে। আস্তে আস্তে সুঁই এর সংখ্যা আরও বাড়তে লাগলো। আমার শরীর প্রচন্ড গরম হয়ে উঠেছে। যেরকম গরম হয় দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করা মোবাইল, সেরকম। আমি কুল কুল করে ঘামছিলাম। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। বাতাসের জন্য মুখ হা করার সাথে সাথে টের পেলাম যে শুধু বাতাস নয় আমার শরীর পানিও চাচ্ছে। প্রচন্ড তৃষ্ণায় মনে হলো বুকের মধ্যে আস্ত একটা মরুভূমির অস্তিত্ব আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে মা ঘরে ঢুকলেন। আমার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছিল। মা ছুটে এসে পাশে বসলেন। ব্যাকুল হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছু বললেন, কিন্তু তিনি কি বললেন আমি শুনতে পেলাম না। মনে হলো প্রচন্ড ধারালো নখ দিয়ে কেউ খামচে ধরলো আমার হৃৎপিন্ড। তারপর উপড়ে নিলো। চোখ অন্ধকার হয়ে এলো।
আর তারপরই দেখলাম আমি সমুদ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক এই একুশ বছরের আমি না। ফ্রক পরা সাত বছরের নীলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বুকের তীব্র ব্যাথাটা অনুভব করছি না আর কিন্তু খুব বিষন্ন আর মনখারাপ লাগছে। আমি কাঁদছিলামও। চোখের পানি গাল বেয়ে নামতেই তার নোনা স্বাদ ঠোঁটে টের পেলাম।
শাপলা জাকিয়া
অতিপ্রাকৃত, রহস্যময় বিষয় তার লেখার অন্যতম প্রধান উপজীব্য। তার গল্প পাঠককে হাত ধরে নিয়ে যায় অদেখা, অজানা এক ভুবনে। ইতিমধ্যে শাপলা জাকিয়ার লেখা গ্রন্থগুলি পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: খুন - ২০১৬, জাতিস্মর এবং একজন লী ২০১৭, রায়হান ২০১৮, শিকার ২০১৯, সমর - ২০২০ এবং ফুয়ানকা২০২১
Related to ফুয়ানকা Fuanka
Related ebooks
I Saw the Light Rating: 4 out of 5 stars4/5Ever. After. Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsThe Void Calls Us Home Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsEkai path chala Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsDesert Teacher Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsNight Shifters Ii: Legend of Suhnoyee Wah Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsAfter Ava Rating: 5 out of 5 stars5/5To Die For Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsThe Wife of a Ghost: Volume 1 Rating: 2 out of 5 stars2/5Chimera Conflict Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsChimera Conflict: A Boston Brain in a Uyghur Body Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsCreators of the Galaxy: The Nether Souls, #1 Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsRedemption Through Forgiveness: How God Used My Mental Illness to Save Me Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsThe Man In My Dream: Dreams Do Come True, #1 Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsStop In The Name Of Love Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsIntertwined Rating: 2 out of 5 stars2/5Creators of the Galaxy Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsCrashing Waves Rating: 3 out of 5 stars3/5Citrus Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsMy Stroke of Inspiration Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsStress Size: How My Hunger for Control Almost Killed Me Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsOnce Innocent: Cries Unheard Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsPersevere: My True Story of Surviving Medical Mystery Rating: 5 out of 5 stars5/5He Taketh the First (A True Dream novel) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsIlifa Lethu Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsThirty Days of Stillness: How Silence Taught Me to Listen Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsBemoaning Voices: How Far Would You Go to Know the Truth? Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsPost-Human Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsHoodlum's Miracle Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsThe Unnamed Rating: 0 out of 5 stars0 ratings
Horror Fiction For You
The Watchers: a spine-chilling Gothic horror novel now adapted into a major motion picture Rating: 4 out of 5 stars4/5Hidden Pictures: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5Dracula Rating: 4 out of 5 stars4/5Edgar Allan Poe Complete Collection - 120+ Tales, Poems Rating: 5 out of 5 stars5/5The Outsider: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5It Rating: 4 out of 5 stars4/5Brother Rating: 4 out of 5 stars4/5Authority: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5Holly Rating: 4 out of 5 stars4/5Annihilation: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5Last Days Rating: 4 out of 5 stars4/5Slewfoot: A Tale of Bewitchery Rating: 4 out of 5 stars4/5The Ocean at the End of the Lane: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5The Whisper Man: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5The Troop Rating: 4 out of 5 stars4/5Cycle of the Werewolf: A Novel Rating: 3 out of 5 stars3/5Lovecraft Country: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5The Mist Rating: 4 out of 5 stars4/5We Have Always Lived in the Castle Rating: 4 out of 5 stars4/5My Best Friend's Exorcism: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5Four Past Midnight Rating: 4 out of 5 stars4/5Pet Sematary Rating: 4 out of 5 stars4/5The Cabin at the End of the World: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5Leave the World Behind: A Novel Rating: 3 out of 5 stars3/5The Hollow Places: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5The Deep Rating: 4 out of 5 stars4/5The Only Good Indians Rating: 4 out of 5 stars4/5Revival: A Novel Rating: 4 out of 5 stars4/5Rita Hayworth and Shawshank Redemption Rating: 4 out of 5 stars4/5Needful Things Rating: 4 out of 5 stars4/5
Related categories
Reviews for ফুয়ানকা Fuanka
0 ratings0 reviews
Book preview
ফুয়ানকা Fuanka - শাপলা জাকিয়া
ফুয়ানকা
১
আমি নীলা, গতকাল মারা গিয়েছিলাম। মারা যাবার ঘন্টাখানেক পর আবার বেঁচে উঠেছি। বাড়ির লোকজন এখন ডাক্তারকে গাল- মন্দ করছেন। বেচারা ডাক্তার অল্পবয়সী একজন সুদর্শন পুরুষ। সদ্য ডাক্তারি পাস করে এই এলাকায় একটা চেম্বার খুলে বসেছেন। ক্যারিয়ারের শুরুতেই এহেন বিপত্তিতে পড়বেন দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। এলাকার কয়েকজন ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, এই ডাক্তারের কাছে রোগী নিয়ে তারা কিছুতেই যাবেন না। জ্যান্ত মানুষকে মরা বলে দিল, এ কেমন ডাক্তার!
হয়েছে কি, গতকাল দুপুরে কলেজ ছিল না। ছুটির দিন বলে আমি একটু ভাত ঘুমের চেষ্টা করেছিলাম। সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি হওয়ায় ওয়েদারটা ঠান্ডা। পর্দা টেনে ঘরটাকে আরও ছায়া ছায়া করে ফেললাম। তারপর ফুল স্প্রিডে ফ্যান ছেড়ে একটা পাতলা সুতি চাদর গায়ের ওপর টেনে দিয়ে শুয়ে পড়লাম, হাতে বই। ভূতের গল্প সমগ্র। একটা গল্প সবে শুরু করেছি হঠাৎ চেহস্ট পেইন শুরু হলো। আমার একুশ বছরের জীবনে এরকম ব্যাথা এর আগেও হয়েছে। আব্বা আমাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ইসিজিও করিয়েছেন। রিপোর্ট নরমাল ছিল। ডাক্তার কিছু গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দিয়ে বিদায় করেছিলেন।
কাল ব্যাথাটা টের পেয়ে প্রথমে বিরক্ত লেগেছিল। আয়েশ করে একটু শুয়েছিলাম, উঠে ওষুধ খেতে হবে ভাবতেই ভালো লাগছিল না। কিন্তু উঠতে গিয়ে অনুভব করলাম, পেইনটা এতো বেশি যে নড়তে পারছি না। মনে হচ্ছে হাজারটা সুঁই কেউ ক্রমাগত পুশ করছে আমার হৃৎপিন্ডে। আস্তে আস্তে সুঁই এর সংখ্যা আরও বাড়তে লাগলো। আমার শরীর প্রচন্ড গরম হয়ে উঠেছে। যেরকম গরম হয় দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করা মোবাইল, সেরকম। আমি কুল কুল করে ঘামছিলাম। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। বাতাসের জন্য মুখ হা করার সাথে সাথে টের পেলাম যে শুধু বাতাস নয় আমার শরীর পানিও চাচ্ছে। প্রচন্ড তৃষ্ণায় মনে হলো বুকের মধ্যে আস্ত একটা মরুভূমির অস্তিত্ব আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে মা ঘরে ঢুকলেন। আমার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছিল। মা ছুটে এসে পাশে বসলেন। ব্যাকুল হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছু বললেন, কিন্তু তিনি কি বললেন আমি শুনতে পেলাম না। মনে হলো প্রচন্ড ধারালো নখ দিয়ে কেউ খামচে ধরলো আমার হৃৎপিন্ড। তারপর উপড়ে নিলো। চোখ অন্ধকার হয়ে এলো।
আর তারপরই দেখলাম আমি সমুদ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক এই একুশ বছরের আমি না। ফ্রক পরা সাত বছরের নীলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বুকের তীব্র ব্যাথাটা অনুভব করছি না আর কিন্তু খুব বিষন্ন আর মনখারাপ লাগছে। আমি কাঁদছিলামও। চোখের পানি গাল বেয়ে নামতেই তার নোনা স্বাদ ঠোঁটে টের পেলাম।
সমুদ্রে একটি জাহাজ ভাসছে। দোতলা জাহাজ। জাহাজটিতে ওঠার জন্য মনের মধ্যে তীব্র আকুলতা তৈরি হলো। আমি ঝাঁপ দিলাম সমুদ্রে। সাঁতরে জাহাজটা ধরবো আমি। যদিও সাঁতার জানি না কিন্তু সাত বছরের নীলা হয়ে দিব্যি সাঁতার কাটছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, জাহাজের ভিতর এমন একজন আছে, যাকে আমি হারাতে পারবো না। তাকে আমার ধরতেই হবে। যেভাবে পারি তাকে ফেরাবো অথবা তার সাথে চলে যাবো।
কিছুক্ষণ পর জাহাজটাকে ধরে ফেললাম। জাহাজে উঠার চেষ্টা করছি কিন্তু মাছের চোখের মতো চোখওয়ালা একটা মানুষ যে সেপাই এর পোশাক পরা, সে আমাকে বাঁধা দিলো। তার হাতে বর্শা। আমি আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
- আমাকে যেতে দিন। প্লিজ যেতে দিন। আমাকে ফেলে উনি চলে যেতে পারেন না।
মাছের চোখের মতো চোখওয়ালা লোকটি বললো,
- সেটা সম্ভব নয়। আপনি এই জাহাজে উঠতে পারবেন না।
হঠাৎ একটি নারীকন্ঠ ভেসে এলো। জাহাজের দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছেন, কন্ঠটি তার। তিনি বললেন,
-ওকে আসতে দাও।
ওনাকে দেখামাত্রই বুঝে ফেললাম, আমি আসলে ওনাকেই খুঁজছি। আমাকে জাহাজে হাত ধরে টেনে তুললো মাছের চোখের মতো লোকটি। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। আমার শরীর থেকে ঝরে পড়া পানিতে ভিজে যাচ্ছিল সিঁড়ির কার্পেট।
সেই নারী, যাকে দেখামাত্রই আমি আমার হৃদয়ে আকুল করা ভালোবাসা অনুভব করছিলাম, তিনি আমাকে একটা কেবিনে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। একটা কাঠের টেবিলের একপ্রান্তে উনি বসলেন। অন্য প্রান্তে আমি বসলাম। তিনি টেবিলের ওপর দিয়ে আমার দুই হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিলেন। আমি তখনও কেঁদে চলেছি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে কোনভাবে বললাম,
-আমাকে ফেলে যাবেন না।
তিনি বললেন,
- তোমার এখনও সময় হয়নি। সময় হলে আমি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।
তিনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আর সাথে সাথে সীমাহীন শূন্যতা আর একবুক হাহাকার আমাকে আঁকড়ে ধরলো। আমি তবু মাথা নীচু করে রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম। ঝাহাজের রেলিং এ উঠে ঝাঁপ দিলাম উত্তাল সমুদ্রে। ভেসে না উঠে তলিয়ে যাচ্ছিলাম গভীর থেকে গভীরে। একসময় চোখ খুললাম।
দেখলাম সমুদ্র নয় আমি আমার ঘরে। বিছানায় শুয়ে রয়েছি। ঘরভর্তি লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে কেউ কেউ আতংক নিয়ে এক পা, দু পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলো। শুধু মা চিৎকার করছেন পাগলের মতো,
-নীলা চোখ খুলেছে! আমার মেয়ে বেঁচে আছে। হে আল্লাহ! তোমার লাখ লাখ শুকুর।
বাবা কাঁদছেন। বাবাকে কাঁদতে আগে কখনো দেখিনি। কাঁদলে বাবাকে দেখতে এমন বুড়ো লাগে, এটা আগে জানতাম না।
আমি বললাম,
- মা, পানি খাব।
কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হলো না। আমি ইশারায় পানি চাইলাম। মা পানি আনতে ছুটে পাশের ঘরে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর সেই ডাক্তারও এলেন। যিনি ঘন্টাখানেক আগে আমাকে মৃত ঘোষণা করেছিলেন।
এই ডাক্তার ছেলেটিকে আমি চিনি। নাম মিনহাজ খান। আমাদের বাড়ির পাশেই চেম্বার। যাওয়া - আসার পথে দেখা হয় প্রায়ই। দাদাজানের অসুস্থতার সময় দাদাজানকে দেখতে এসে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন,
- বেশিদিন নেই। খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ। আর যদি বেঁচে যান তবে বলবো মিরাকল। তখন কিন্তু চাইনিজ খাওয়াতে হবে। অবশ্য আপনি বললেই যে আমি চাইনিজের দাওয়াত নিতে পারবো, তা নয়। সামনের মাসে ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছি। এসব নিয়ে খুব ব্যস্ততা চলছে।
আমি কোন উত্তর না দিয়ে সরে এসেছিলাম। দাদাজানকে আরও অভিজ্ঞ ডাক্তার দেখানো হয়েছিল, দুইমাসের মাথায় তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলেন।
একদিন ডাক্তার মিনহাজ খানের চেম্বারের সামনের ডিসপেনসারি থেকে নাপা কিনছি, উনি হন্তদন্ত হয়ে একটা ব্যাগ হাতে কোত্থেকে যেন এলেন। আমাকে বললেন,
- আপনি কিন্তু আমাকে খুব ফাঁকি দিলেন। চাইনিজ খাওয়ালেন না। আপনার দাদাজান তো দেখি একদম সুস্থ হয়ে গেছেন। আমার প্রেসক্রাইব করা ওষুধ কন্টিনিউ করেছিলেন, তাইতো? এই জন্যই মিরাকলটা হয়েছে। জানেন, এটা খুব আনন্দের যে আমার প্রেসক্রাইব করা ওষুধ একজন মৃতপ্রায় মানুষকে জীবন ফিরিয়ে দিলো।
আমি বললাম না যে, দাদাজান তার ওষুধ খাননি। অন্য একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে সুস্থ হয়েছেন। আমি বরং বলেছিলাম,
- আপনি বাংলাদেশেই আছেন এখনও?
উত্তরে তিনি বোকা বোকা হেসেছিলেন। নাকের ডগায় ঝুলে পড়া চশমাটা আঙ্গুল দিয়ে পিছনে ঠেলে বলেছিলেন,
-আপনি মনে রেখেছেন! বাহ্! আপনার স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। চলে যাবো..চলে যাবো তো! খুব বেশি হলে বাংলাদেশে আর এক মাস আছি।
তারপর ছয়মাস চলে গেছে। ওনাকে আমি বাড়ির পাশের চেম্বারটাতে এখনও দেখি।
যাই হোক, গতকাল সবার আলাপচারিতা থেকে যেটা বুঝেছিলাম, সেটা হলো আমি অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারালে মা, বাবাকে খবর দেন। আর বাবা ডাক্তার মিনহাজকে ডেকে আনেন। তিনি এসে আমাকে পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন। আত্মীয় - স্বজনকে খবর দেয়া ছাড়াও যখন কারা আমাকে গোসল করাবেন, এটা ঠিক করা হচ্ছিল, তখনই আমি চোখ মেলে তাকাই।
ডাক্তার মিনহাজকে আবার ধরে আনার পর তিনি আমাকে পুনরায় পরীক্ষা করে বললেন,
- কি আশ্চর্য! কি মিরাকল! আমার ডাক্তারি জীবনে এরকম ঘটনা আর দেখিনি।
আমার ছোটমামা বললেন,
- আপনার ডাক্তারি জীবন! আপনি ডাক্তার নাকি? একজন জীবিত মানুষকে মৃত বলে চলে গেলেন! আপনার নামে তো কেস করে দেয়া উচিত।
এ কথায় ডাক্তার মিনহাজ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন,
- কি বলতে চান আপনি? আমি ভুয়া ডাক্তার? না জেনে কথা বলবেন না। নীলা ম্যাডাম আসলেই মারা গিয়েছিলেন। আচ্ছা, খালাম্মা আপনি বলুন, আপনি যখন আপনার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন, তখন কি তার শ্বাস চলছিল?
আম্মা আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
- না, শ্বাস ছিল না। আমার বিশ্বাস না হওয়ায় আমি নীলার নাকের সামনে আঙ্গুল নিয়ে দেখেছি।
মিনহাজ ডাক্তার বললেন,
- খালুজান, আপনি বলেন, যখন প্রেশার মাপি তখন মেশিনটা জিরো জিরো শো করেছিলো কিনা? আপনি সামনে ছিলেন।
বাবা বললেন,
- আমার কোন অভিযোগ নেই বাবা। আমার মেয়ে বেঁচে উঠেছে, এতেই আমি খুশি। তোমার ভুল হোক বা না হোক, আমি মাফ করলাম। মেয়েকে ফিরে পেয়ে আমি মনে মনে আজ সবাইকে মাফ করে দিয়েছি। যাদের ওপর আমার সামান্য অভিযোগও ছিল, সবার আজ মাফ।
ডাক্তার মিনহাজ বাবার উত্তরে আরও অস্থির হয়ে বললেন,
- খালুজান নীলা ম্যাডাম কিন্তু বিপদমুক্ত না। ইংল্যান্ডে ২০০২ এবং ২০০৯এ এমন ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু বেঁচে ওঠার পর একজন দুইদিন, আরেকজন চারদিন বেঁচে ছিলেন। তারপর আবার মারা গেছেন। আমাদের উচিত নীলা ম্যাডামকে এক্ষুনি হসপিটালে শিফট করা। কিছুই বলা যায়না।
আমাকে তাই গতকালই এই হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। নানা রকম টেস্ট করা হচ্ছে । আমাকে নিয়ে একটা পত্রিকা নাকি নিউজও করে ফেলেছে আর সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল না হলেও কিছুটা জানাজানি হয়েছে । পরিচিতরা সবাই খুব ফোন করছে। তারা দেখতে আসতে চায়। বেডে শুয়ে এসব তথ্য কানে আসছে আমার।
আমি হসপিটালের এই কেবিনটায় দুই ধরনের মানুষ দেখছি। এক ধরনের মানুষ হচ্ছেন, আমার বাবা- মা, ডাক্তার, নার্স এরা। আরেক ধরনের মানুষগুলি কেমন ছায়া ছায়া, বাতাসের মতো। এরা নির্লিপ্ত মুখে ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ভেসে যায়। এরা হাঁটে না, বাতাসে পেঁজা তুলার মতো ভাসে। মাঝে মাঝে কথাও বলে। কন্ঠগুলি পুরুষের বা নারীর নয়। অদ্ভুত শোনায়, তাদের উচ্চারিত শব্দগুলি যেন নরম তাল শ্বাসের মতো। শক্ত করে ধরা যায় না, ফেটে যায়। আবার এড়িয়েও যাওয়া যায় না। তালশাঁসের পাতলা খোসার মতো কানে লেগে থাকে।
শব্দের সাথে তালশাঁসের তুলনা আমি দিচ্ছি, কারণ কোন এক বিচিত্র কারণে আমি শব্দের স্বাদ পাচ্ছি। বাবা- মা যে শব্দে কথা বলেন, তার স্বাদ নারিকেলের মতো। ডাক্তার - নার্সদের উচ্চারিত শব্দগুলি তরমুজ আর বাঙ্গির মতো।
আমার কিছুটা ভয়- ভয় করছে। আমি কি তবে এখনও অসুস্থ? মারা যাবো কাল বা পরশু?
মনে মনে প্রশ্নটা করতেই কেউ উত্তর দিলো,
- না, আপনি মারা যাবেন না।
শব্দগুলি তালশাঁসের মতো। আমি চট করে পাশ ফিরে তাকালাম। দেখলাম, মাছের চোখের মতো চোখওয়ালা সেই জাহাজের লোকটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে!
মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই, নিষ্প্রাণ মুখ। মনে হচ্ছে তার রক্তশূন্যতা আছে, এমন প্রচন্ড ফ্যাকাসে ত্বক। সেপাইদের মতো পোশাক পরে আছে লোকটা । মাথায় ছুঁচালো টুপি, হাতে বর্শা। পোশাকের রংও তার মতোই বিবর্ণ।
আমি বললাম,
- আপনাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম। আপনি স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এলেন কেমন করে?
সে প্রশ্নের উত্তর দিলো না লোকটা। সে কিছুটা কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন যেন। আরেকটু কুঁজো হয়ে বললো,
-আপনি আরও অনেকদিন বাঁচবেন।
আমি বললাম,
-আপনি কে? আপনি হাতে বর্শা নিয়ে ঘোরেন কেন?
লোকটা মাথা দুলিয়ে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু হঠাৎ মা কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,
-বিড়বিড় করে কি বলছিস রে মা? কিছু লাগবে?
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। আমার চিন্তা তাকে বড্ড কাবু করে ফেলেছে। আমি মারা গিয়ে আবার ঘন্টাখানেকের মধ্যে বেঁচে ওঠায় মাও যেন মরে