মহাশূন্যের গন্ধ নাকি পোড়া মাংসের মতো
5/5
()
About this ebook
A dark fast paced psychological thriller about a failed writer in search of a truth.
Read more from Minhaj Rahman
দানো/Dano Rating: 5 out of 5 stars5/5ধ্বংস নগর Rating: 5 out of 5 stars5/5চন্দ্রগ্রস্থ/Chondrogrostho Rating: 5 out of 5 stars5/5
Related to মহাশূন্যের গন্ধ নাকি পোড়া মাংসের মতো
Reviews for মহাশূন্যের গন্ধ নাকি পোড়া মাংসের মতো
1 rating0 reviews
Book preview
মহাশূন্যের গন্ধ নাকি পোড়া মাংসের মতো - Minhaj Rahman
মিনহাজ রহমান
স্বত্বাধিকারী
সালমা সুলতানা মুক্তা
উৎসর্গ
মৌমিতা এবং টুনু
According to Astronaut Chris Hadfield the space smells like burnt meat...
আমি জানি গুলির আওয়াজটা হওয়ার সাথে সাথে গত আট মাস ধরে চলতে থাকা রাইটার্স ব্লকটা আমার কেটে যাবে। আজ প্রায় সতেরো বছর পর তৃতীয়বারের মতো ফায়ার হতে যাচ্ছে রিভলবারটা।
পয়েন্ট ৩৮ কোল্ট ডিটেকটিভ। ১৯৬৮ সালে ম্যানুফেকচারড আমেরিকান মডেল। সিরিয়াল নম্বর ৯৬২২০১। সেকেন্ড সিরিজের এই নাকবোঁচা রিভলবারগুলোর ব্যারেল খুব ছোট হয়। মাত্র তিন ইঞ্চি। কিন্তু যখন ফায়ার করা হয় কান ফাটানো আওয়াজ হয়। আমার দাদাজান মরহুম সিরাজউদ্দিন শেখের হাত ধরে এসেছিলো রিভলবারটা আমাদের বাড়িতে। আমাদের বংশের একমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র।
রিভলবারটা প্রথমবার ফায়ার করা হয় আমাদের জসিমউদ্দিন রোডের গলির অনেক ভেতরে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা দোতালা বাড়িটার পেছনে বড় বড় গাছ গাছালিতে ঘেরা খোলা জায়গাটাতে। সন্ধ্যা নেমে আসছিলো। আমি দু হাতে দোতালায় বারান্দার শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দাদাজান তার পাঞ্জাবীর পকেটে কি যেন লুকিয়ে ধরে রেখে নীচ থেকে চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে ইশারায় আমাকে নীচে আসতে বললেন। তিনি তার সদ্যপ্রাপ্ত লাইসেন্স করা খেলনা নাতিকে দেখাতে চাচ্ছিলেন। আমি চুপিচুপি মার চোখ বাঁচিয়ে নীচে আসলে, আমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে পাঁচিলের শেষ মাথায় একটা প্রকান্ড মেঘশিরীষ গাছের দিকে তাক করে রিভলবারটা ফায়ার করেন তিনি। হঠাৎ প্রচণ্ড আওয়াজে সবার প্রথমে ঘরে ফেরা পাখিগুলো সন্ধ্যার আকাশকে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে জানাতে চিৎকার করতে করতে উড়ে চলে যায়। আমি ভয় পেয়ে দাদাজানকে খামচে জড়িয়ে ধরি। আমার মা উপর থেকে দৌড়ে নীচে চলে আসেন ভীত মুখে। তার পেছন পেছন কাজের লোকেরা। এসেই আমাকে দাদাজানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তার পেটের কাছটাতে আমার মুখটা চেপে ধরেন। মার গায়ে তখন মশলার অদ্ভুত গন্ধ। কিছুটা আতঙ্ক আর অনেকখানি অভিযোগ মিশিয়ে বলেন,
- বাবা আপনি কি করেন ওর সামনে এগুলো... ও ছোট মানুষ...
দাদাজান গম্ভীর মুখে রিভলবারটার সেফটি ক্যাচ অন করে পাশে রাখা বাগানের ইজি চেয়ারটাতে বসতে বসতে বলেছিলেন,
- এখন থেইকাই দেহুক... সিরাজ শেখের নাতীন হে... হ্যার জীবনে সহায় সম্পত্তি আর শত্রুর কখনো অভাব হইবো না।
রিভলবারটা দ্বিতীয়বার ফায়ার হয় আজ প্রায় সতেরো বছর হয়ে গেলো। সেদিনটাও ছিলো ভর সন্ধ্যাবেলা। স্থানটাও এক। আমাদের জসীমউদ্দিন রোডের দোতালা বাড়ি। তবে ফায়ারটা এবার নীচতলায় হয়নি। হয়েছিলো দোতালায় আমাদের স্টাডি রুমে। রিভলবারের তিন ইঞ্চি ব্যারেলটা ছিলো আমার বাবার মুখে পোরা। ট্রিগারে ছিলো উনার নিজেরই বুড়ো আঙ্গুল। আমার বাবা, মরহুম ফয়েজ উদ্দিন শেখ। মাঝবয়সে উনার মানসিক ভারসম্যহীনতা দেখা দিয়েছিলো। প্যারানয়েড একজন মানুষ ছিলেন। আত্মকে হত্যা করেছিলেন তিনি। ওইদিনও আমার মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিলেন। তার গায়ে হয়তো সেদিনও মশলার অদ্ভুত গন্ধ ছিল। কিন্তু সেইদিন আমার ভীত মাকে জড়িয়ে ধরবার জন্য আমি ছিলাম না। তখন আমি বোর্ডিং স্কুলে পড়তাম।
আজ ১২ অগ্রহায়ণ। ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। ইংরেজি সন ২০১৬। রাতের দ্বিতীয় প্রহর। সতেরো বছর পর কোল্ট রিভলবারটা তৃতীয়বারের মতো আবারও জিঘাংসা ভরে গর্জে উঠবে। আমি জানি গর্জনের আওয়াজে সবার প্রথমে আমার রাইটার্স ব্লকটা কেটে যাবে। ইচ্ছে করবে আমার চামড়ায় বাঁধানো খেড়ো খাতা আর পয়েন্ট সাত মিলিমিটার নিবের গাঢ় নীল পার্কার কলমটা নিয়ে কোথাও বসে পড়ি। লিখতে শুরু করি।
দিন কয়েক আগে...
১
খুট করে একটা শব্দ করে দরজাটা বিনীত ভঙ্গীতে খুলে গেলো।
চাবি ছাড়া লক খোলবার কাজটা যে এত সহজ আগে জানতাম না। দু’ দিন আগে রাতে চোরের মতো এসে লকটার ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। ইন্টারনেটে চাবি ছাড়া লক খোলবার ইউটিউব ইন্সট্রাকশনের অভাব নেই। ব্যাপারটা বেশ আতঙ্কজনক। কত মানুষ কত কারণে কাজটা ঘরে বসে শিখে ফেলছে। আর তার চেয়েও আতঙ্কজনক কত সহজ এই লক খোলবার কাজটা। বিশেষ করে গোল মাথাওয়ালা নবের এই লকগুলো। প্লাস্টিকের ফেলে দেওয়া কোকের বোতল প্রথমে একটা ক্রেডিট কার্ডের মাপে চারকোনা করে কেটে নিতে হয়। পাতলা কিন্তু শক্ত হওয়ার কারণে খুব সহজে গোল মাথার নবসহ দরজাগুলোর পাশে ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া যায়। হ্যাচটার পাশে ঘাট মতো বসিয়ে হ্যাঁচকা টান দিলেই হ্যাচটা সরে গিয়ে দরজাটা খুলে আসে। সিম্পল এন্ড ডেঞ্জারাস।
অনুমুতি ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর অপরাধ। কিন্তু পৃথিবীর সব অপরাধীরাই নিজের কাজের পিছনে একটা কিন্তু রাখে। যে কিন্তুটা তার বিবেককে অপরাধটা করবার সময় কিছুটা হলেও শান্ত রাখে। আমার কিন্তুটা হলো যার এপার্টমেন্টে চুরি করে ঢুকছি সে আমার এক সময়ের প্রাণপ্রিয়া স্ত্রী। মৃতা স্ত্রী, যদি আরও পরিস্কার করে বলতে হয়। অন্তত কিছুদিন আগ পর্যন্তও আমি তাই জানতাম।
নীলা। নীলা চৌধুরী। আমার স্ত্রীর নাম। একসময় আমি আদর করে ডাকতাম নীলাঞ্জনা। জীবনানন্দ সাহেবের নীলাঞ্জনা।
নীলাঞ্জনা, ঐখানে যেও নাকো তুমি
বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে
ফিরে এসো নীলাঞ্জনা
নক্ষত্রের আগুন ভরা এই রাতে
কবিতার নীলাঞ্জনা, জীবনানন্দ সাহেবের কথা শুনেছিলো কিনা তা আমার জানা নেই। তবে আমার নীলা আমার কথা শোনে নি। সে গিয়েছিলো আরেক যুবকের সাথে দেখা করতে আমাকে না জানিয়ে। প্রায়ই হয়তো যেতো। ঠিক যুবক নয়। মাথা ধরানো প্রয়োজনের অতিরিক্ত পুরুষালি গন্ধের কড়া পারফিউম মাখানো এক মধ্যবয়স্ক ঢাকাই ফিল্ম প্রোডিউসারের সঙ্গে।
অযথা নিজের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে লাভ নেই। মানছি কাজটা অন্যায়। আর এমনও না যে আমরা এখন স্বামী স্ত্রী। কিন্তু নীলা, তুমি খুব ভালো করে জানো লেখকদের কৌতূহল কতটা অসুস্থ পর্যায়ের হতে পারে। আমার তোমার কাছে কিছু চাওয়ার নেই নীলা। তোমাকে আমার সাথে আবার ঘরও করতে বলছি না। আমার শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দরকার। ব্যস। আমি তো জানতাম তুমি মারা গেছো নীলা। একজন মৃত মানুষ কিভাবে আবার শোবিজের আলো ঝলমলে দুনিয়ায় সিনেমার নবাগতা নায়িকা হিসেবে ধুলোমাখা এই মলিন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়?
গত এক সপ্তাহ ধরে তোমাকে ফলো করছি। বারিধারার বেশ ভেতরের দিকে শহরের শেষ বেঁচেকুচে থাকা খোলা জায়গাটার বুকে পারা দিয়ে বিলাসবহুল এই সারিসারি এপার্টমেন্টগুলো উঠেছে। ঝকঝকে নতুন সব এপার্টমেন্ট। বুকিং শেষ হয়ে গেলেও প্রায় বেশিরভাগ এপার্টমেন্ট এখনও খালি। ওঠেনি বিশেষ কেউ। তোমার মতো দু একজন প্রিভিলিজড ছাড়া। যদিও বিল্ডিং কর্তৃপক্ষ এখনও সিকিউরিটির পেছনে ওভাবে খরচ করা শুরু করেনি। তার প্রমাণ আমি নিজেই। বাইরে লাঠি হাতে ঝিমুতে থাকা বুড়ো দারোয়ানটার চোখ ফাঁকি দিয়ে উপরে আসতে কোন সমস্যাই হয়নি আমার।
বেশিরভাগ রাতেই এখানে থাকো না তুমি। সারাদিন এখানে ওখানে শুটিঙে ব্যস্ত থাকো। বিকেল হয়ে আসলে হয়তো ফেরো কোনও কোনও দিন। সন্ধ্যাবেলা কুচকুচে কালো কাঁচে ঘেরা একটা বেগুনি রঙের BMW-x5 এসে তোমাকে নিয়ে যায়। কোনদিন গুলশান ক্লাব, কোনদিন ঢাকা ক্লাব অথবা কোনদিন হয়তো গাজীপুরের বাগান বাড়ি। রাতটা বাইরেই কাটে তোমার। ভোর হলে এখানে ফেরো ক্লান্ত তুমি।
আট তলার উপরে এপার্টমেন্টটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে থাকলেও বাইরের পৃথিবীর আলোয় বেশ বোঝা যাচ্ছে তোমার ইন্দ্রপুরী। অন্ধকার চোখে সয়ে আসছে। বাতি জ্বালবার প্রয়োজন বোধ করছি না। বাইরে থেকে অযথা কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি না এই মুহূর্তে। ফ্লোর স্ট্রাকচারটা এখন কিছুটা বুঝতে পারছি। ঢুকেই সরু করিডোর। লিভিং রুম। ডাইনিং। ওপাশটাতে নিশ্চয়ই তোমার কিচেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। দামি এপার্টমেন্ট নীলা। বেশ দামি এপার্টমেন্ট তোমার। আমার জসীমদ্দিন রোডের পুরোন পলেস্তরা খসা পৈতৃক বাড়ি কিছুই না এর তুলনায়। একই সাথে কিছুটা ঈর্ষান্বিত এবং কিছুটা রাগান্বিত অনুভব করছি। দামি আসবাবপত্র দিয়ে বোঝাই নয় তোমার লিভিং রুমটা। হাল্কা পাতলা সব মডার্ন সুইডিশ ডিজাইনের ফার্নিচার দিয়ে নিজের রুচিবোধের পরিচয় দেওয়ার একটা সূক্ষ্ম চেষ্টা অনুভব করা যায়। ‘আমার রুচিবোধ আছে’ এর থেকে ‘আমার রুচিবোধ সবার চেয়ে আলাদা’ এমন একটা ভাব প্রমাণ করবার চেষ্টা সবসময় তোমার মাঝে ছিলো। লিভিং রুমটাকে হাতের ডান পাশে রেখে করিডোর ধরে এগিয়ে গেলে মুখোমুখি দুটো দরজা। কাঠের কারুকাজ করা দরজা দুটোর যেকোন একটার পেছনে নিশ্চয়ই তোমার মাস্টার বেডরুম। আমি খুব সাবধানে একপাশে মাটিতে দু পা উঁচিয়ে হ্রেষা রব করতে থাকা একটা মার্বেলের আরবী ঘোড়া থেকে পা বাঁচিয়ে সন্তর্পণে এগোলাম। দেখা যাক কি আছে প্রথম দরজাটার পেছনে।
এটা গেস্ট রুম। একেবারেই সাজসজ্জাহীন। আহামরি কোন আসবাবপত্র নেই। এটাচড বাথ। একপাশে ব্যালকনি। তেমন কোন আগ্রহ বোধ করছি না। দরজাটা সাবধানে ভিড়িয়ে আমি দ্বিতীয় দরজাটার নবে হাত রেখে নিঃশব্দে মোচড় দিলাম।
তোমার মাস্টার বেডরুম। কোন সন্দেহ নেই তোমার মাস্টার বেডরুম এটা। বলে দিতে হয় না।
অদ্ভুত এক শূন্যতা বোধ ভেসে বেড়াচ্ছে তোমার রাজকীয় রুমটার ভেতরে। মহাদেবের প্রসাদ সেবনে যেমন শূন্যতা বোধ হয় তেমনটা। দু প্রান্তে গর্জনরত সিংহের মাথাওয়ালা বিশাল কুইন সাইজ বেড ...মিহি কারুকাজ করা লিনেনের চাদর...ভারী সাইড টেবিল...নিঃসঙ্গ ল্যাম্প... গাঢ় বেগুনি রঙের ভ্যালভেটের পর্দা...পর্দার ওপাশে ব্যালকনি। এটাচড বাথ। এক পাশে দানব আকৃতির বিশাল কাঠের কাজ করা ভারী আলমারি। ওপর পাশে পুরো দেয়াল জুড়ে বিল্ট