Discover millions of ebooks, audiobooks, and so much more with a free trial

Only $11.99/month after trial. Cancel anytime.

Birendra Samagra I
Birendra Samagra I
Birendra Samagra I
Ebook405 pages3 hours

Birendra Samagra I

Rating: 0 out of 5 stars

()

Read preview

About this ebook

শান্তিনিকেতন ১৯৯০। পদার্থ বিদ্যার গবেষণার কাজে কোলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনে আসতে হয় অনিরুদ্ধ চৌধুরী কে। এই শান্তিনিকেতনে এসে এমন একটি মানুষের সঙ্গে তার আলাপ হয় যে তার জীবনের গতিপথ চিরকালের মত ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। বীরেন্দ্র সান্যাল। পেশায় হারপেটোলজিস্ট। অর্থাৎ সরীসৃপদের নিয়ে তার কাজ কারবার। তার চেহারাটি অনিরুদ্ধকে বারবার জয়বাবা ফেলুনাথের গুণময় বাগচির

LanguageBengali
Release dateMar 7, 2024
ISBN9789360497606
Birendra Samagra I

Reviews for Birendra Samagra I

Rating: 0 out of 5 stars
0 ratings

0 ratings0 reviews

What did you think?

Tap to rate

Review must be at least 10 words

    Book preview

    Birendra Samagra I - Satanik Basu

    রমানাথ সমাদ্দার

    বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন রমানাথ সমাদ্দার। এই কিছক্ষন আগে মর্নিংওয়াক সেরে ফিরেছেন। চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে তিনি খবরের কাগজের পাতা উল্টে পাল্টে দেখছিলেন। চার নম্বর পাতার শেষের দিকে একটি বিজ্ঞাপনের দিকে তাঁর চোখ আটকে গেলো। তিন লাইনের একটি বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি দিয়েছে ক্যালকাটা লেদার হাউস নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। সংস্থাটি এক বছরের চুক্তিতে আইনজীবী চেয়ে চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা, এই দুটোর কথাই সেই বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত আছে। নিচে একটি ঠিকানা দেওয়া আছে এবং সেই ঠিকানায় যত শীঘ্র সম্ভব চাকরির আবেদন পত্র পাঠাতে বলা হয়েছে। রমানাথ সমাদ্দার বেশ মন দিয়ে বিজ্ঞাপনটি পড়লেন। তারপর ঠিক করলেন যে ক্যালকাটা লেদার হাউসের ঠিকানায় চাকরির আবেদন পত্র পাঠিয়ে দেবেন।

    রমানাথ সমাদ্দারের বাড়ি মানিকতলায়। পেশায় তিনি উকিল। একটি দোতলা বাড়িতে থাকেন। পৈত্রিক বাড়ি। নিজের বাড়ির একতলায় একটি চেম্বার করেছেন। নাম দিয়েছেন আর.এস ল ফার্ম। কিন্তু পসার সেরকম নেই। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও বড় মক্কেল আজ পর্যন্ত তাঁর বরাতে জোটেনি। তবে দলিল সংক্রান্ত কাজ এবং ছোটখাটো কেসে পরামর্শ দেওয়ার মত মক্কেল তাঁর জুটেই যায়। তাই খবরের কাগজে বেরনো বিজ্ঞাপনটা তাঁর কাছে যথেষ্ট লোভনীয় ছিল। মনে মনে ভাবছিলেন যে আয় বাড়ানোর এই এক ভাল সুযোগ। তাই দেরী না করে তড়িঘড়ি তিনি চাকরির আবেদন পত্রটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিন দিনের মাথায় সেই আবেদন পত্রের উত্তর জানিয়ে ক্যালকাটা লেদার হাউস থেকে একটি চিঠি এলো রমানাথ সমাদ্দারের কাছে। যত শীঘ্র সম্ভব তাঁকে ক্যালকাটা লেদার হাউসে দেখা করতে বলা হয়েছে। চিঠিটি পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন রমানাথ সমাদ্দার। এইবার বোধহয় অর্থ চিন্তা ঘুচবে।

    তাই আর দেরী না করে যে দিন চিঠি এলো সে দিনই ক্যালকাটা লেদার হাউসে দেখা করতে চলে গেলেন রমানাথ সমাদ্দার। বিজ্ঞাপনে দেওয়া ঠিকানায় ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলেন তিনি। কিন্তু যে বাড়িতে অফিস, সেই বাড়িটি দেখে তাঁর মনে একটা সন্দেহ দেখা দিলো। বিজ্ঞাপনে যে ঠিকানাটি দেওয়া ছিল, সেটি পার্ক স্ট্রীটের একটি বহু পুরনো বাড়ির ঠিকানা। বাড়িটি সিমেট্রির ঠিক উল্টো দিকের একটি গলিতে। নাম মিউজিক প্যারাডাইস। এইরকম একটি বাড়িতে অফিস? মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়ল রমানাথ সমাদ্দারের। ঠিক জায়গায় এসেছি তো? কথাটি মনে হতেই প্যান্টের পকেট থেকে ঠিকানাটি বার করে আর একবার দেখে নিলেন তিনি। হ্যাঁ, ঠিক জায়গায়ই তো এসেছেন। ভেতরে ঢুকবেন নাকি ভাবছেন, ঠিক সেই এক ভদ্রলোক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন—

    কাউকে খুঁজছেন স্যার?

    রমানাথ সমাদ্দার আপন মনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাই ভদ্রলোক কে দেখেন নি। তিনি চমকে উঠে ভদ্রলোকটির দিকে তাকালেন। বছর পঞ্চাশেক বয়স। রমানাথ সমাদ্দার জিজ্ঞাসা করলেন—

    এই বাড়িতে কোন অফিস আছে নাকি জানেন?

    সে এই বাড়িতে তো প্রায় দিনই নতুন নতুন অফিস গজিয়ে উঠেছে বললেন ভদ্রলোক।

    নতুন নতুন অফিস গজিয়ে উঠছে মানে? একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন রমানাথ সমাদ্দার।

    আজ্ঞে এই বাড়িতে কোন অফিসই স্থায়ী নয়। নতুন নতুন অফিস খোলে। চার পাঁচ মাস ব্যবসা করে চলে যায়। আমি এই বাড়ির দারোয়ান। তা আপনি কোন অফিস খুঁজছেন? জিজ্ঞাসা করলেন ভদ্রলোক।

    ক্যালকাটা লেদার হাউস। চারদিন আগে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের পাতায় চাকরির আবেদন জানিয়ে একটি বিজ্ঞাপন বেরিয়ে ছিল। এই ঠিকানাই তো দেওয়া ছিল বললেন রমানাথ সমাদ্দার।

    তা গত সপ্তাহে চারজন বাবু এসে দোতলার একটি ঘরে অফিস খুলেছেন বটে। কিন্তু অফিসের নাম তো আমি বলতে পারবোনা স্যার। আমি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ। তাই অফিসের নাম বলতে পারবোনা। আপনি বরং একবার গিয়ে দেখুন বললেন ভদ্রলোক।

    আপনার নাম কি? জিজ্ঞাসা করলেন রমানাথ সমাদ্দার।

    আজ্ঞে কালিপদ দাস বললেন কালিপদ বাবু।

    রমানাথ সমাদ্দার দুর্গা দুর্গা বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে সোজা দোতলায় চলে গেলেন। দোতলায় সর্ব সাকুল্যে তিনটি ঘর। তার মধ্যে দু নম্বর ঘরের সামনে একটি ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লেখা ক্যালকাটা লেদার হাউস। তিনি অফিস ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা মারলেন। মিনিট দুয়েকের মধ্যে এক ভদ্রলোক দরজা খুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন।

    আজ্ঞে আমার নাম রমানাথ সমাদ্দার। আমিই আপনাদের চাকরির বিজ্ঞাপনের উত্তরে আবেদন পত্র পাঠিয়ে ছিলাম। আজই তার উত্তর এসেছে। তাই দেখা করতে চলে এলাম বললেন রমানাথ সমাদ্দার।

    ও আসুন বলে ভদ্রলোক রমানাথ সমাদ্দারকে ভেতরে নিয়ে এসে একটি সোফায় বসতে বললেন।

    আপনি একটু বসুন। স্যার একটু বাইরে গেছে। আমি ওনার সহকারী। আমার নাম অনিমেষ ঘোষ। আপনার চিঠিটি আমরা পড়েছি। আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা দুইই আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। তাই আপনাকে দেখা করতে বলা হয়েছিল। আপনি একটু বসুন। আমি স্যার কে ডেকে আনছি বলে অনিমেষ ঘোষ দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

    রমানাথ বাবু আশা করেছিলেন যে বাড়িটি পুরনো হলেও অফিসটি কমপক্ষে সাজানো গোছানো হবে। কিন্তু অফিস ঘরের অবস্থা প্রায় এই বাড়িরই মত। দুটো ঘর নিয়ে গোটা অফিসটি। একটি বসার ঘর, অর্থাৎ যে ঘরে এখন তিনি বসে আছেন। আর একটি ঘর তালা বন্ধ। বসার ঘরে একটি সোফা, একটি টেবিল, দুটি চেয়ার এবং আসবাব পত্র বলতে একটি আলমারি। এরা মাইনে দেবে? নিজের মনে হাসলেন রমানাথ সমাদ্দার। সত্যি টাকার লোভ বড়ই ভয়ানক। আগে যদি জানতেন যে অফিসের অবস্থা এতটাই খারাপ, তাহলে তিনি কখনই চাকরির জন্য আবেদন পাত্র পাঠাতেন না। অফিসটি ঘুরে দেখছিলেন রমানাথ সমাদ্দার। ঠিক সেই সময় অনিমেষ ঘোষ এক ভদ্রলোক কে নিয়ে অফিসের ভেতরে এলেন। ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকেই বললেন—

    ভেরি সরি রমানাথ বাবু । আসলে আমি জানতাম না যে আপনি আজই আসবেন। তাই একটু বাইরে বেরিয়ে ছিলাম। আমার নাম সমরেশ দত্ত। আমিই ক্যালকাটা লেদার হাউসের মালিক। বসুন। আপনার সঙ্গে কথা আছে।

    রমানাথ সমাদ্দার টেবিলে লাগানো একটি চেয়ারে বসলেন। সমরেশ দত্ত বললেন—

    চিন্তা করবেন না রমানাথ বাবু । আমরা প্রতিষ্ঠিত সংস্থা। আমাদের যথেষ্ট নাম আছে। হ্যাঁ কলকাতায় হয়তো নেই। তার অবশ্য কারণও আছে। কলকাতায় আমরা এই প্রথম। আমাদের আগের অফিসটি বোম্বেতে ছিল। একটা সমস্যা হওয়াতে সংস্থাটি বেচে দিতে হয়। তাই এবার যাতে কোন সমস্যা না হয় সেই জন্য শুরুতেই আইনজীবী চেয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। আপনার মুখ দেখে বুঝতে পারছি যে অফিসটি আপনার পছন্দ হয়নি। আর হবেই বা কি করে? আর পাঁচটা অফিসের মত যে সাজানো গোছানো নয়। তার ওপর এই রকম একটি পুরনো বাড়িতে অফিস। কি ঠিক বললাম তো?

    রমানাথ সমাদ্দার লজ্জিত মুখ করে বললেন—

    তা একটু প্রশ্ন তো মনে এসেইছে।

    "আপনাকে তাহলে পুর ঘটনাটি খুলে বলি। আজ থেকে বছর ছয়েক আগে আমি আর অনিমেষ বোম্বেতে এই সংস্থাটি প্রথম খুলি। তখন অবশ্য নাম ছিল দত্ত লেদার হাউস। আমারই নামে নাম ছিল। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন যে আমরা চামড়ার দ্রব্যের ব্যবসা করি। ব্যবসা ভালই চলছিলো। কিন্তু সঠিক ভাবে ব্যবসা চালাতে গেলে বেশ কিছু ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হয়। সেই অভিজ্ঞতাটি আমার বা অনিমেষ কারোরই ছিলোনা। আগেই বলেছি যে ব্যবসা ভালই চলছিলো, তাই লাভও ভালই হচ্ছিল। ব্যবসা শুরুর প্রায় দু বছর পর হিসেবের খাতায় গড়মিল আবিস্কার করলাম। আমি অবশ্য করিনি। অনিমেষই করেছিল। বিশাল অঙ্কের হেরফের। এক কর্মচারীর ওপর সন্দেহও হোল। তাকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু সে স্বীকার করলো না। তাই বাধ্য হয়েই তার বিরুদ্ধে পুলিশে রিপোর্ট করলাম। জল আদালত পর্যন্ত গড়াল। প্রচুর চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমার কেসটা হেরে যাই। মিথ্যে অভিযোগ করার দায়ে আমাদের অনেক টাকা জরিমানা দিতে হয়। এছাড়া উকিলের পেছনেও অনেক টাকা খচর হয়ে গিয়েছিলো। তাই বাধ্য হয়েই দত্ত লেদার হাউস বেচে দিতে হোল।

    তারপর আমি আর অনিমেষ দুজনেই কলকাতায় চলে আসি। এই বছর দুয়েক নানা রকম কাজ করেছি। কিন্তু আমাদের রক্তে ব্যবসা মিস্টার সামাদ্দার। তাই চাকরি ছেড়ে আবার ব্যবসায় এলাম। হ্যাঁ আগের মত অবশ্য মূলধন নেই এখন।, কিন্তু আপনার মাস মাইনেটা অবশ্যই দিতে পারবো। আর টাকার অঙ্কটাও নেহাতই কম নয়। তাছাড়া আবার করে ব্যবসা চালু করার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিতে হবে। তাই বুঝতেই পারছেন যে একজন আইনজীবী থাকাটা কতোটা জরুরী। তাই জন্যই আপনাকে এখানে আসতে বলা। এবার আপনি যদি রাজি থাকেন তো কাজ শুরু করে দেবো" বললেন সমরেশ দত্ত।

    কত মাইনে দেবেন? জিজ্ঞাসা করলেন রমানাথ সমাদ্দার।

    আপাতত মাসে কুড়ি হাজার টাকা। তারপর ব্যবসা আবার আগের মত শুরু হলে আপনার মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হবে বললেন সমরেশ দত্ত।

    টাকার অঙ্কটা শুনে চোখ কপালে উঠে গেলো রমানাথ সমাদ্দারের। কুড়ি হাজার টাকা। মানে বছরে দু লাখ চল্লিশ হাজার টাকা। তিনি একটু অবাক হয়ে সমরেশ দত্তর দিকে তাকালেন। সমরেশ দত্ত রমানাথ সমাদ্দারের মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন—

    আপনাকে তো আগেই বলেছি রমানাথ বাবু যে আপনার প্রাপ্য টাকা আপনি পাবেন। এবার বলুন আপানি আমাদের এই অফারে রাজি নাকি?

    আমায় কাজটা ঠিক কি করতে হবে? জিজ্ঞাসা করলেন রমানাথ সমাদ্দার।

    আমাদের সংস্থার যাবতীয় কাগজপত্র আইনসম্মত ভাবে তৈরি রাখতে হবে। আর প্রত্যেক মাসের হিসেবটা আপনাকে দেখে দিতে হবে। যদিও এটা আপনার কাজ নয়, তবুও এটা আপনাকে করে দিতেই হবে। আর যেহেতু নতুন করে আবার সব শুরু করছি তাই মূলধনের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে একটু লোন দরকার আপনাকে আগেই বলেছি। আর আপনি থাকলে সেটা পেতেও সুবিধে হবে কারন আপনার নিজের ল ফার্ম আছে। তাই লোনের চুক্তিপত্রের সাক্ষী হিসেবে যদি আপনার স্বাক্ষর থাকে তাহলে আমাদের সংস্থার সতাতা এবং বিশ্বস্ততার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন উঠবে না। আর ব্যাঙ্কেরও লোন দিতে অসুবিধে হবেনা। আর হিসেবের খাতাটা আপনাকে কেন দেখতে বলছি সেতো বুঝতেই পারছেন। আসলে আমাকে আর অনিমেষকে ব্যবসার কাজে ব্যাস্ত থাকতে হবে। তাই এই দায়িত্বটা অন্য কাউকে দিতে পারবো না। এবার আর কোন ঝুঁকি নিতে চাইনা। আপনাকে রোজ এই অফিসে আসতে হবে না। আপনি আপনার বাড়িতে বসেই কাজ করবেন। শুধু সপ্তাহ শেষে আপনাকে একবার করে এই অফিসে আসতে হবে সারা সপ্তাহের লেনদেনের হিসেব দেখাতে বললেন সমরেশ দত্ত।

    রমানাথ সমাদ্দার একটু হেসে বললেন—

    আপনি অত চিন্তা করবেন না মিস্টার দত্ত। আমি চাকরীটি করব। অনেক ধন্যবাদ। শুধু একটা প্রশ্ন আছে।

    হ্যাঁ বলুন বললেন সমরেশ দত্ত।

    এই চাকরীটা তো এক বছরের জন্য। তো তারপর আপনার এখানে কাজ করতে হলে কি নতুন করে আবার আবেদন করতে হবে? প্রশ্ন করলেন রমানাথ সমাদ্দার।

    সমরেশ দত্ত হেসে বললেন—

    আপনি যদি করতে চান করতে পারেন। আসলে আমরা শুরুটা কোলকাতাতে করলেও বছর খানেক পর আবার বোম্বে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সেটা অবশ্য পুরোটাই নির্ভর করছে ব্যবসা কেমন চলে তার ওপর। এবার যদি আমরা বোম্বে যাই এবং আপনি যদি যেতে রাজি না হন, তখন অন্য আইনজীবী আমাদের দেখতে হবে। তাই এই চুক্তির কথা বলা। যাতে কোন ভুল বোঝাবুঝি না হয়।

    ও আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। এবার বলুন কবে থেকে শুরু করব বললেন রমানাথ সমাদ্দার।

    ঠিক আছে। তাহলে আগামীকাল থেকেই কাজ শুরু করা যাক। আগামীকাল সকাল এগারোটা নাগাত চলে আসুন। ব্যাঙ্কে যেতে হবে লোনের ব্যাপারে কথা বলতে। দুঃখের বিষয় আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারবো না, আগামীকাল আমাকে একবার বোম্বে যেতে হবে একটা কাজের ব্যাপারে। অনিমেষ আপনার সঙ্গে যাবে। অসুবিধে হবে বলে তো মনে হয়না বললেন সমরেশ দত্ত।

    কোন অসুবিধে হবেনা মিস্টার দত্ত। এ ব্যাপারে কি লেখাপড়া করতে হয় আমি জানি। আমি পুরো ব্যাপারটা দেখে নেব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন বললেন রমানাথ সমাদ্দার।

    অনেক ধন্যবাদ রমানাথ বাবু । আসুন। নমস্কার বললেন সমরেশ দত্ত।

    রমানাথ সমাদ্দার অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। কালিপদ দাস রাস্তার এক কোনে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছিলেন। রমানাথ সমাদ্দারকে দেখে তিনি বললেন—

    কাজ হোল বাবু?

    হ্যাঁ হোল। আচ্ছা কালিপদ বাবু, এই অফিস গুলো বেশীদিন টেকেনা কেন? জিজ্ঞাসা করলেন রমানাথ সমাদ্দার।

    সেতো আমি বলতে পারবো না বাবু। তবে এই জায়গাটা খুব একটা ভালো নয়। সে দিনের বেলায় যতই সুন্দর দেখাক না কেন রাত পড়লেই একে একে সব শুরু হয়। একে তো সামনে গোরস্থান। ভুতের ভয় পাওয়ার মানুষের তো আর অভাব নেই। তার ওপর এই গলিতে চুরি চামারি খুব হয়। আর তাছাড়া মদ, গাঁজা বুঝতেই পারছেন। কোন দিনও সন্ধ্যেবেলা আসবেন তাহলেই বুঝতে পারবেন। দেখবেন নেশায় চুর হয়ে এদিক ওদিক সব বসে আছে। সেই সব কারনেই হয়তো কেউ বেশীদিন থাকার ভরসা করতে পারেনা। এই বাড়িতে আগে এক খ্রিস্টান বাবু থাকতেন। তাও সে বছর কুড়ি আগের কথা। তখন এ বাড়িতে গান বাজনা হত। তারপর তিনি একদিন হঠাৎ মারা গেলেন। সেই থেকে বাড়িটি খালিই পরে থাকতো। তারপর বছর দুয়েক হোল একটা দুটো করে অফিস হতে শুরু করেছে। কিন্তু ওই যে বললাম না, জায়গাটা রাতে একদম ভালো না। তাই একটা দুটো করে অফিস হয়। আবার উঠেও যায়। বললেন কালিপদ দাস।

    কে জানে, হবে হয়তো। কিন্তু এখন যে অফিসে গেছিলাম তাদের বেশ নামডাক আছে শুনলাম। তাই এরা তো টিকবে বলেই মনে হচ্ছে। যাকগে এখন আসি কালিপদ বাবু। কাল আবার আসব বলে রমানাথ সমাদ্দার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

    পরদিন ভোর ছটায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো রমানাথ সমাদ্দারের। রাতে অনেক দেরীতে শুলেও উত্তেজনার বশে সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেছে। রাতে ঘুম আসছিলো না তাঁর। সারাদিনের ঘটনাটি বারবার মনে পড়ছিল। তাই ঘুমোতে ঘুমোতে প্রায় দেড়টা হয়ে গিয়েছিলো। গত রাতের উত্তেজনাটা আজও পুরো মাত্রায় ছিল রমানাথ সমাদ্দারের মধ্যে। বারবার ঘড়ির দিকে দেখছিলেন। এগারোটায় যেতে বলেছে। দশটায় বেরলেই হবে। হাজার উত্তেজনা সত্ত্বেও মনে মনে একটু খুশিই হয়েছিলেন রমানাথ সমাদ্দার। সে সংস্থা যতই ছোটো হোক না কেন, কথা বলে একবারের জন্যও তা মনে হয়নি রমানাথ সমাদ্দারের। আর তাছাড়া টাকার অঙ্কটা ভুললে চলবে না। মাসে কুড়ি হাজার টাকা। জলখাবার খেয়ে ঠিক দশটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন রমানাথ সমাদ্দার। এগারোটার ভেতরেই ক্যালকাটা লেদার হাউসে পৌঁছে গেলেন তিনি। পৌঁছে দেখলেন যে সদর দরজা আজ খালি। কালিপদ বাবু সেখানে নেই। রমানাথ সমাদ্দার সোজা দোতলায় উঠে গেলেন। ক্যালকাটা লেদার হাউসের দরজা খোলাই ছিল। তিনি ভেতোরে একবার উঁকি মেরে কাউকে দেখতে না পেয়ে দরজায় কয়েকবার টোকা মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন অনিমেষ ঘোষ। রমানাথ বাবুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন—

    ও আপনি এসে গেছেন? ভেতোরে আসুন। আর দশ মিনিটের মধ্যে বেরবো।

    রমানাথ সমাদ্দার ভেতোরে ঢুকে সোফায় বসে বললেন—

    সব কাগজ পত্র নিয়ে নিয়েছেন তো?

    সে সব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব গুছিয়ে নিয়ে নিয়েছি। এবার ভালোয় ভালোয় লোনটা পেলে বাঁচি বলেন অনিমেষ ঘোষ।

    সেটা আমি সামলে নেবো। আর বলছিলাম যে কোন ব্যাঙ্কে যাবেন? জিজ্ঞাসা করলেন রমানাথ সমাদ্দার।

    ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কে যাবো। আলিপুর ব্রাঞ্চ। ন্যাশানাল লাইব্রেরির কাছে। আমার গাড়িতেই যাবো বললেন অনিমেষ ঘোষ।

    আলিপুর? এই পার্কস্ট্রিটেই তো ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের একটি ব্রাঞ্চ আছে। সেখানে গেলেই তো হয় বললেন রমানাথ সমাদ্দার।

    আসলে ওই ব্রাঞ্চে আমার একজন পরিচিত কর্মচারী কাজ করে। তাই আরকি বললেন অনিমেষ ঘোষ।

    ও আচ্ছা। তাহলে তো ভালোই হবে বললেন রমানাথ সমাদ্দার।

    এগারোটা দশ নাগাত রমানাথ সমাদ্দার এবং অনিমেষ ঘোষ গাড়িতে চড়ে আলিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ব্যাঙ্কে পৌঁছে একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি ম্যানাজারের ঘরটা দেখিয়ে দিলেন। দরজার গায়ে নেমপ্লেট লাগানো আছে। প্রমোদ বিশ্বাস। দরজায় টোকা মারতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো—

    ভেতোরে আসুন

    রমানাথ সমাদ্দার আর অনিমেষ ঘোষ ভেতোরে ঢুকে দুটো চেয়ারে বসলেন। অনিমেষ ঘোষ সমস্ত কথা বললেন প্রমোদ বিশ্বাসকে। সব শুনে প্রমোদ বিশ্বাস বললেন—

    দেখুন মিস্টার ঘোষ আপনাদের মত ছোটো কোম্পানি কে লোণ দেওয়া একটু ঝুকি পূর্ণ হয়ে যায়। আসলে আপনাদের কোম্পানির নাম আগে আমি শুনিনি। মানে যে কোম্পানিটি উঠে গেলো আরকি। আসলে আমি বোম্বেতে বেশ কয়েক বছর ছিলাম। তখনও কিন্তু আমি দত্ত লেদার হাউসের নাম শুনিনি। সেই  জন্যই বলছি আরকি। সে যাইহোক রমানাথ বাবু  যখন আশ্বাস দিচ্ছেন, তখন আমি লোণ অ্যাপ্রুভ করে দিচ্ছি। এই ফর্মটা একটু ফিল আপ করে দিন।

    আপনিই করে দিন রমানাথ বাবু । আপনি না থাকলে লোণটা পাওয়া অসম্ভব ছিল বললেন অনিমেষ ঘোষ।

    রমানাথ সমাদ্দার যত্ন সহকারে ফর্মটি ফিল আপ করে দিলেন। সব শুদ্ধু লোণ বরাদ্দ হোল এক লাখ টাকা। এক বছরের জন্য। এক বছর পর থেকে তিন কিস্তিতে লোণ শোধ করতে হবে। দুপুর দুটো নাগাত সমস্ত কাজ সেরে ক্যালকাটা লেদার হাউসে ফিরলেন রমানাথ এবং অনিমেষ। সমরেশ দত্ত ওঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওঁদের দেখে বললেন—

    কি কাজ হোল?

    রমানাথ সমাদ্দার হেসে বললেন হ্যাঁ। সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে হয়ে গেছে। আমি তো আপনাকে বলেছিলাম মিস্টার দত্ত যে আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি সব সামলে নেবো

    ভাগ্যিস রমানাথ বাবু  ছিলেন। নাহলে লোণটা পেতামই না। উনি ওনার ল ফার্মের কথা বললেন। ওনাকে সাক্ষী হিসেবে ফর্মে সইও করতে হোল। তারপর লোণ অ্যাপ্রুভ হয়েছে বললেন অনিমেষ ঘোষ।

    আপনাকে অনেক ধন্যবাদ রমানাথ বাবু । আপনি এই টাকাটা রাখুন। এটা আপানার বেতনের পঞ্চাশ শতাংশ। বাকিটা মাস শেষ হলে আপনাকে দিয়ে দেবো। প্রতি মাসে অবশ্য এইভাবে দেওয়া হবেনা। পরের মাস থেকে মাসের শেষেই বেতন পাবেন। কিন্তু আজ আমাদের একটা এত বড় উপকার করলেন। তাই এটা নিয়ে নিন বলে সমরেশ দত্ত একটি ব্রাউন রঙের খাম রমানাথ সমাদ্দারের দিকে এগিয়ে দিলেন।

    খামটা নেওয়ার সময় রমানাথের হাতটা একটু কেঁপে গেলো। জীবনে প্রথমবার এতো টাকা এক সাথে নিচ্ছেন। তিনি টাকার খামটা নিয়ে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে বললেন অনেক ধন্যবাদ।

    সমরেশ দত্ত বললেন—

    ঠিক আছে আপনি এখন বাড়ি চলে যান। আমরা আজ থেকেই কাজ শুরু করব। আপনি সমস্ত কাগজ পত্র তৈরি করে রাখুন। আর সপ্তাহের শেষে একবার করে এসে হিসেবের লেনদেনটা একবার বুঝে যাবেন।

    রমানাথ সমাদ্দার ঠিক আছে। নমস্কার বলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। আজ রমানাথ যথেষ্ট খুশি। ব্যাগে কড়কড়ে দশ হাজার টাকা। হাতে যেন চাঁদ পেলেন রমানাথ সমাদ্দার। এবার আর বাসে করে বাড়ি ফিরলেন না। একটা প্রাইভেট ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।  সেই সপ্তাহের শেষে তিনি ক্যালকাটা লেদার হাউসে গিয়ে লেনদেনের সমস্ত হিসেব দেখে বাড়ি চলে এলেন। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। বেশি খাটনির কাজ নয় অথচ বিশাল মাইনে। প্রত্যেক সপ্তাহের শনিবার করে অফিসে যান এবং হিসেবের লেনদেন দেখে বাড়ি চলে আসেন। এইভাবে মাস দুয়েক কেটে গেলো। তারপর একদিন সমরেশ দত্ত রমানাথ সমাদ্দারকে ফোন করে বললেন যে কয়েক দিনের জন্য অফিস বন্ধ থাকবে। কর্ম সূত্রে তাঁকে এবং অনিমেষ ঘোষ, দুজনকেই একবার দিল্লী যেতে হবে দিন দশেকের জন্য। তাই রমানাথ বাবু যেন দিন দশ পরে আবার অফিসে যান। মনে মনে রমানাথ ভাবলেন যে এর থেকে সুখের চাকরি তিনি আর পেতেন না। এমনিতে তো অফিস যেতে হয়না। সব কাজ ঘরে বসেই হয়। তার ওপর দশ দিনের ছুটি। এ যেন সোনায় সোহাগা। দেওয়ালে টাঙানো মা দুর্গার ছবিটির দিকে তাকিয়ে তিনি হাত জোড় করে প্রনাম করে নিলেন।

    দশ দিন দেখতে দেখতে কেটে গেলো। রমানাথ সমাদ্দার ভাবলেন যে আরও দিন দুয়েক অপেক্ষা করে তারপর ক্যালকাটা লেদার হাউসে যাবেন। তো যে দিন যাবেন ঠিক করলেন, সেই দিনই ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক থেকে একটা ফোন এলো রমানাথ সমাদ্দারের কাছে। ফোনটা পেয়ে

    Enjoying the preview?
    Page 1 of 1