অপূর্ব পৃথিবী (একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস) (Bengali)
()
About this ebook
স্বপ্নের দেশ আমেরিকা বেড়াতে এলাম আমার ভাই ডাঃ ফজলুর রহমানের বাড়ীতে। জন্মভূমি থেকে একেবারে বিপরীত আবহাওয়ার দেশ, যা আমার বয়সের সাথে খাপ খায়না। আমি যেন ভেঙ্গে না পড়ি তাই ভ্রাতৃবধু জাহান আরা রহমানের পীড়াপীড়ি কিছু লিখতে হবে। তিন যুগেরও বেশী সময় যাকে কবরস্থ করেছি তাকে কি হাতড়ে পাওয়া যায়।
তার প্রগাঢ় ভক্তি শ্রদ্ধা ঢেকে দিল আমার স্নেহময়তা তাই নিস্তেজ হাতে ধরতে হল কলম।
আমি জানি পাগলের প্রলাপেও কৌতুক আছে, ভাষাহীন বোবার চাহনীতে অলঙ্কার আছে।
পাগলের পেছনে ঢিল ছুড়ে কেউ আনন্দ পায়। বোবাকে ক্ষেপিয়ে কেউ হেসে গড়াগড়ি যায়। তেমন আনাড়ী হাতের মুঠোয় প্রাণহীন প্রসূতি কি প্রসব করল তা দেখবারও নিশ্চয় কেউ আছে।
এতটুকুই আমার সান্ত্বনা।
Read more from বজলুর রহমান Bazlur Rahman
আলোকদিয়ার আলো (উপন্যাস) / Alokdiyar Alo (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsসাদা কাগজ (উপন্যাস) / Shada Kagoj (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsনিয়তি নিরন্তর (উপন্যাস) / Niyoti Nirontor (Bengali) Rating: 5 out of 5 stars5/5সোনার হাতের পরশ (উপন্যাস) / Shonar Hater Porosh (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsঅপরূপ(একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস) (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsপথের শেষে (উপন্যাস) / Pother seshe (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratingsমুক্তির সূর্যোদয় (উপন্যাস) / Muktir Surjodoy (Bengali) Rating: 0 out of 5 stars0 ratings
Related to অপূর্ব পৃথিবী (একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস) (Bengali)
Reviews for অপূর্ব পৃথিবী (একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস) (Bengali)
0 ratings0 reviews
Book preview
অপূর্ব পৃথিবী (একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস) (Bengali) - বজলুর রহমান Bazlur Rahman
উৎসর্গ
মেজ বউ
জাহান আরা রহমান
কে
অপূর্ব পৃথিবী
মৌসুমী বায়ু বয়ে চলেছে। সমস্ত আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ঝড়ো বাতাস অবিরাম গতিতে গাছ গাছালিতে আঘাত হানছে। তার সাথে বৃষ্টি হচ্ছে গুড়ি গুড়ি আবার কখনও বা ঝম ঝম করে। গত দু’সপ্তাহ ধরে ভীষণ গরম পড়েছে। খুব কষ্ট পেয়েছে স্রষ্টার সৃষ্টি জীবেরা। এই মৌসুমী বায়ু সমস্ত জীবের মনে স্বস্তি এনে দিয়েছে। শোবার ঘরে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে একখানা বই পড়ছিলেন হাশিম খান। পার্ল এস বাকের ‘মা’ পড়তে পড়তে আনমনা হয়ে গেলেন। কি পড়ছেন তা হৃদয়পটে গাঁথতে পারছেন না। কেবলই যেন অতীতে হারিয়ে যাচ্ছেন। বই বন্ধ করে মুখ তুললেন। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। শুক্লা অষ্টমীর চাঁদ মেঘে ঢেকে রয়েছে। মেঘের সাথে চাঁদ যেন লুকোচুরি খেলছে। মেঘ যখন সরে যাচ্ছে চাঁদ তখন ফিক্ করে হেসে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে দিগন্ত ব্যাপি। তাই বাইরের দৃশ্যটি মনোরমই দেখাচ্ছে। হাশিম খান দেখছেন প্রকৃতি আঁধারের ঘোমটা দিয়ে একবার নিজেকে ঢেকে ফেলছে আবার ক্ষণিক চাঁদের আলোয় নিজের অপূর্ব রূপ বিকশিত করে দিচ্ছে। প্রকৃতির এই অপরূপ রূপ ভাবুককে ভাবিয়ে তোলে, প্রেমিককে করে অসহায়, সংসারীকে দেয় মাধুর্যতা, সংসার বিরাগীকে করে উতলা। যারা এই রূপের সাথে মিতালী করতে পেরেছে তারা হয়েছে চিরস্মরণীয়, আর যারা একে বুঝতে পারেনি তারা হয়রান হয়ে অকারণে ঘুরেছে দিগ্বিদিকি। উপভোগ করবার আগেই নি:শেষ করেছে নিজের আবেগ অনুভূতিকে। একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ত্যাগ করে হাশিম খান চিন্তার গভীরে তলিয়ে গেলেন। অতীতের ছেড়া পাতাগুলো যেন জোড়া লেগে আজ তার সামনে রূপালী পর্দার মত ভেসে আসছে একের পর এক।
তার শৈশবের বন্ধু ওয়াজেদ। গরীবের ছেলে অথচ মেধাবী। প্রতিযোগিতায় হাশিম খান কোন সময় ওয়াজেদের সাথে পেরে উঠেননি। তিনি ধনী পিতার একমাত্র সন্তান। অনেক অর্থ ব্যয়ে কয়েকজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়াতেন তার পিতা। ওয়াজেদের বই কেনার পয়সাই দিতে পারতেন না তার পিতা। বন্ধুদের বই চেয়ে নিয়ে পড়ে শ্রেণীতে প্রথম পদটায় তার নাম থাকতো বরাবর। হাশিম খান তাকে ঘৃণা করতেন না বরং মাঝে মাঝে তাকে সাহায্য করে বন্ধুত্বের প্রতিদান দিতেন। শৈশবের কথা। ওয়াজেদের সাথে একদিন হাশিম খান গিয়েছিলেন তাদের বাড়ী। তার মা নিজের ছেলের মতই তাকে কোলে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন- বাবা, তুমি বড় লোকের ছেলে, ওয়াজেদ গরীবের ছেলে, তোমাদের বন্ধুত্ব তোমার বাবা মা হয়তো মেনে নেবেন না। তোমরা ছেলে মানুষ, না বুঝে বন্ধুত্ব করেছ, বড় হলে এ আবেগ থাকবে না। তোমাদের চলার পথ হবে ভিন্ন। তুমি থাকবে উপরে, ওয়াজেদ থাকবে নীচে। কোন দিন মনেও পড়বে না ওয়াজেদ বলে শৈশবে আমার এক বন্ধু ছিল। হাশিম খান তার বন্ধুর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- চাচী মা, দোয়া করবেন আমাদের এই বন্ধুত্ব যেন চিরদিন অটুট থাকে। আমি কোন দিন ওকে ভুলব না। ওয়াজেদের মা হাশিমের মুখে চুমো খেয়ে বলেছিলেন- আমি দোয়া করি প্রভু তোমার কথার মর্যাদা রক্ষা করবার হেকমত দান করুন।
হাশিম খান কোন দিন তার প্রতিজ্ঞার কথা ভুলেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী পর্যন্ত তিনি তার বন্ধুকে আর্থিক এবং অন্যান্য বিষয়ে সাহায্য করে এসেছেন। তার বাবা মা প্রথমে বিরক্তিবোধ করলেও শেষ পর্যন্ত একমাত্র পুত্রের বন্ধু প্রীতির কাছে নতি স্বীকার করেন। অনেকে হিংসায় তাদের মাঝে ফাটল ধরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে ফিরে গেছে। মাষ্টার্সের শেষ পরীক্ষা হয়ে গেলে হাশিমের বাবা তাকে খুব ঘটা করে ধনী লোকের সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে ছিলেন। এই বিয়েতে ওয়াজেদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। বিয়ের পরের দিনই হাশিম খান তার নব বধুর সাথে ওয়াজেদের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, আমি চাই তুমি আমাদের এই সম্পর্ককে আরও গভীরে টেনে নিয়ে এসো। তার স্ত্রী নার্গিস বেগম মুচকি হেসে বলেছিলেন, আমি জানি না তোমার বন্ধুর সাথে কেমন ব্যবহার করতে পারব। ভাল কিছু করতে না পারলেও মন্দ যেন না করি সেই চেষ্টাই করব।
নার্গিস বেগমের বাবা আশরাফ চৌধুরী ছিলেন একজন ডাক সাইটে আমলা। মেয়ের জেদাজেদিতে তিনি ওয়াজেদকে সিভিল সার্ভিসে উচ্চ পদে চাকুরী দিয়েছিলেন। প্রভু যেন নিজ হাতে ওয়াজেদের ভাগ্যলিপি লিখে দিয়েছিলেন। এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়। বন্ধু এবং বন্ধু পত্নীর প্রতি তার দেহ মন সব সময় কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়ত। এরপর নার্গিস বেগমের পীড়াপীড়িতে ওয়াজেদকে বিয়ের পীড়িতে বসতে হয়। ধনী কন্যা ধনীর বধু নার্গিস বেগম নিজ তত্ত্বাবধানে তার এক বান্ধবীর সাথে বন্ধুর বিয়ে দেন। খুব ঘটা করে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। হাশিম দম্পতি কোন দিন ক্ষণিকের জন্যেও ওয়াজেদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। পৃথিবীর এই জনারন্যে এমন আশ্চর্য দৃষ্টান্ত খুব একটা সচারচর দৃষ্টি গোচর হয় না। হাশিম দম্পতির এই মহানুভবতার জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলে ওয়াজেদ। দুই দম্পতির মাঝে এমন আন্তরিক হৃদ্যতা, প্রেম ভালবাসা, একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ অনেকের মনে হিংসার উদ্রেক সৃষ্টি করে দেয়। তবু তাদের বিকশিত যৌবনের অমূল্য দিনগুলো মাত্রারিক্ত উপভোগ করেছে। তাদের মধুময় সময়গুলো মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে গেল আনন্দের সাথে। এর পরের ঘটনার কথা মনে পড়তে হাশিম খানের হৃদয় অব্যক্ত বেদনায় মুচড়ে পড়লো।
ব্যবসায়িক কার্যপোলক্ষ্যে হাশিম খান গেছেন হংকং। এর মধ্যে ঘটে গেল হৃদয় বিদারক ঘটনা। দুর্ভাগ্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওয়াজেদের গাড়ী পাহাড়ী রাস্তা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল গভীর খাঁদে। চালক এবং আরোহী দু’জনই মৃত্যু বরণ করলো। ছিন্ন ভিন্ন বিকৃত মৃত্যু দেহের সামনে যখন তার স্ত্রী লাবনীকে নিয়ে আসা হল তখন দেখা মাত্রই মুর্ছা গেল। মর্মাহত নার্গিস বেগম নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে শবদেহ সৎকার করে লাবনীকে চার বছরের শিশু সন্তানসহ তার নিজের বাস ভবনে নিয়ে এলো। বিদেশ বিভুয়ে এই দু:খজনক সংবাদ পেলে হাশিম খান নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারবে না এই ভেবে নার্গিস বেগম কেবল এতটুকুই বললেন- তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে এসো, এখনই তোমাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন।
সংবাদ পেয়ে হাশিম খান অস্থির হয়ে পড়লেন। ব্যবসা সূত্রে কতবার দেশ বিদেশ ঘুরেছেন, কিন্তু কোন সময় এমন সংবাদ তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকে পাননি। কাজ অসমাপ্ত রেখেই হংকং থেকে বাড়ী ফিরলেন। বিমান বন্দরেই তার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর কাছে দুর্ঘটনার কথা জানতে পারেন। এই কঠিন আঘাতে তাঁর মানসিক প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়ে গেল। টলতে টলতে বাড়ী এসেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বন্ধুর প্রতি তাঁর কেমন প্রাণের আকর্ষণ ছিল তা এতেই অনুভব করতে কষ্ট হয় না। নার্গিস বেগমের দৃঢ়তা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হাশিম খান তার বন্ধু শোক বিস্মৃত হয়ে গেলেন। লাবনীও আস্তে আস্তে প্রিয়তম হারানোর ব্যথা ভুলতে তার স্মৃতি শিশু সন্তান আদেলকে বুকে জড়িয়ে ধরতো, শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ফিরত।
আরও কয়েক বছর কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল। হাশিম খান আদেলকে একটা নাম করা ইংরেজী স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। এখন সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। এই সময় এক মর্মান্তিক আঘাত খান পরিবারের উপর আঁছড়ে পড়লো। ছয় মাসের শিশুকন্যা ফৌজিয়াকে রেখে নার্গিস বেগম চিরদিনের জন্যে চলে গেলেন অজানা দেশে। যাওয়ার আগে লাবনীর একখানা হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলেছিলেন- লাবনী, তুই আর এই সংসার ছেড়ে কোন দিন কোথাও যাসনে বোন। মেয়ে আর স্বামীকে তোর হাতে দিয়ে গেলাম। তুই মনে করিস, এই মেয়ে আমার এই স্বামী আমার। তুই আমাকে কথা দে আমার অন্তিম মিনতি রাখবি, তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারব। উভয়ের চোখে ছিল বাঁধ ভাঙ্গা পানি। লাবনী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। ডুকরে কেঁদে উঠে নার্গিস বেগমের বুকের উপর মাথা রেখে বললো- তুই যে কঠিন শর্ত চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিস, তা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমার যে নেই বোন। নার্গিস বেগম লাবনীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো- এই শর্ত কঠিন নয়, সহজ সরল শর্ত, মানতে কোন বেগ পেতে হবে না। কান্না জড়িত কন্ঠে লাবনী কেবল ডেকেছিল আপা!
নার্গিস বেগম পাশে উপবিষ্ট স্বামীর একখানা হাত ধরে বলেছিলেন, তুমি মনে কর আদেল তোমার ছেলে, ফৌজিয়া তোমার মেয়ে, লাবনী তোমারই নার্গিস। করুণ চাহনী স্বামীর মুখের দিকে মেলে জিজ্ঞেস করেছিল- বল তুমি তাই মনে করবে কি না?
পাষাণ মূর্তির মত হাশিম খান তার মৃত্যু পথযাত্রী স্ত্রীর পাশে বসেছিলেন, কোন কথা বলতে পারেননি। লাবনী এই বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারেনি। ফৌজিয়াকে বুকের সাথে চেপে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল। এদৃশ্য দেখে নার্গিস বেগমের ম্লান মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে বেরুলো। বললো- আমি স্বস্তি পেলাম। স্বামীর হাতে চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো- বল, তুমি আমার কথা রাখবে কি না?
তুমি একী বলছ নার্গিস? তোমার শর্ত পালন করা আমার পক্ষেতো অসম্ভব। লাবনী মনে করবে অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমি তার স্বাধীন ইচ্ছার উপর হস্তক্ষেপ করছি। এই দুর্বল মুহূর্তে তুমি এমন অঙ্গীকার আমার কাছে চেওনা। তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, এ বাড়ী লাবনীর। এ বাড়ীতে সে চিরদিন থাকতে চাইলে ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকবে। প্রয়োজন হলে আমি না হয় আমাদের অন্য বাড়ীতে যেয়ে থাকব।
না-না, তুমি এ বাড়ী ছেড়ে অন্য কোন বাড়ীতে যেতে চেও না। এ বাড়ীই আমার স্বর্গ। এখানেই কেটেছে আমাদের জীবনের অনেকগুলো বছর, কি করে ভুলে যাবে তুমি সেসব স্বপ্নময় দিনগুলোর কথা। এ বাড়ীতেই তোমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে। আমার অবস্থান যেখানে ছিল সেখানে থাকবে লাবনী। আমার এই দাবী তোমাকে মেনে নিতেই হবে। লাবনী! এই দিকে একটু আয়তো আপা।
লাবনী ফৌজিয়াকে বুকে চেপে দরজার কাছে এসে দাড়ালো। নার্গিস বেগম বললেন আজ থেকে তুই আর লাবনী নস্, নার্গিস বেগম, বুঝেছিস?
আর কোন কথা কেউ বলবার সময় পেল না, তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।
অব্যক্ত বিচ্ছেদ বেদনায় হাশিম খানের মন প্রাণ যেন ছিঁড়ে ফেড়ে শতধা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। একটা লম্বা দীর্ঘ নি:শ্বাস ত্যাগ করে পাশে তাকালেন শয্যার উপর। পালঙ্গের উপর পুরু গদি, তার পরে বিছানো আছে একটা দামী চাদর। বিদ্যুতের আলো সেখানে পড়ে এক অপূর্ব শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সময় সেখানে আরও একজন থাকবার কথা কিন্তু সে নেই। যৌবনের অকেনগুলো বছর যার সাথে কাটিয়েছেন স্বপ্নের মত। হ্যাঁ তার কাছে সেই মধুময় দিনগুলো আজ স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে। এক বছরেরও বেশী সময় কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেই অবধি পাশের ঐ শয্যাটি এমনই নি:সঙ্গ অবস্থায় কাতর চাহনি মেলে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। বাক হীন বোবা সেই চাহনী। তার মুখে ভাষা নেই কিন্তু কত কথা সে যেন অবিরাম কয়ে চলেছে। জড় বস্তুর দিকে চেয়ে হাশিম খান সবই বোঝেন, কান পেতে শোনেন তার দীর্ঘ বিরহের ইতিহাস। লাবনী তার প্রিয়তমা স্ত্রীর বন্ধু। নার্গিস বেগম তার দীর্ঘ শিক্ষা জীবনের বন্ধু স্বামীর বন্ধুর সাথে বিয়ে দিয়ে আরও ঘনিষ্ঠ করে নিয়েছিল। তার নিজের আরাম আয়েশের সমস্ত উপকরণ দু’দম্পতিতে ভাগ করে নিয়েছেন। বাইরের জগতের পরিচিত জনেরা ধরেই নিয়েছিল, লাবনী নার্গিস বেগমের বোন, আর ওয়াজেদ হাশিমের ভাই। কোন দুর্বল মুহূর্তে ক্ষণিকের জন্যেও তাদের মাঝে চিড় ধরেনি। বিধাতা তার সৃষ্টির মাঝে এমন দু’একটা অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত দেখিয়ে মানুষকে অবাক করে দিয়েছেন, শিখিয়েছেন মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য বোধ। তিনি প্রকৃতিকে যেমন বিচিত্র রূপে গড়েছেন তেমন মানুষের চলার পথে রচনা করেছেন অসংখ্য বাঁক। তাইতো মানুষের অন্তরে গেঁথে দিয়েছেন জ্ঞান আর বিবেক। অবাধ চিন্তার খোরাকের জন্যে দিয়েছেন অসংখ্য উপকরণ। এর কোনটা মানুষ আয়ত্তে আনতে পারে কোনটা পারে না। এর ভিতরে যে গুড় রহস্য রয়েছে তার ঢাকনী কেউ উন্মোচন করতে পারে কেউ পারে না। তাই সুখ দু:খ, ব্যথা বেদনা পাশাপাশি থেকে যায়।
বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে সেই সাথে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, মেঘের গর্জন মাঝে মাঝে প্রকৃতিকে চমকে দিচ্ছে। হাশিম খান ভাবছে এমন উপভোগ্য কত রজনী নার্গিস বেগমের সাথে ভোগ করেছেন। আজ সে নেই তার পাশে। তাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্যে চলে গেছে লোকচক্ষুর
অন্তরালে। যাওয়ার আগে যে কঠিন দাবী সে রেখে গেছে তাই নিয়ে দীর্ঘ একটি বছরেরও বেশী সময় তাঁর অন্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। যখন একা থাকেন তখন বাইরের মত তার অন্তরে এমন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যায় কিন্তু সেই ঝড় থামাবার মত কোন যুৎসই সমাধান খুঁজে পান না। বন্ধুরা বলেন- তুমি এতো কি ভাবো বলো দেখি, ভাবী তোমাকে সোজা পথ দেখিয়ে গেছেন, সেই পথে নেমে পড়লেই তো সব সমাধান হয়ে যায়। সব আত্মীয় স্বজনের সেই একই কথা। কিন্তু তিনি সব সময় তাদের কথা এড়িযে গেছেন। অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি, মানসম্মান পূর্বের তুলনায় এখন অনেক উপরে। আগে সবাই তাকে নাম ধরে ডাকতো। এখন নামের শেষে সাহেব খেতাবটিও জুড়ে বসেছে। তুমি থেকে আপনিতে এসেছেন, অনেক বাড়ী গাড়ীর মালিক হয়েছে। বিধাতা কোন কিছুই অপূর্ণ রাখেননি, কেবল তাঁর পাশে আপনজনটি নেই। পূর্ণতার মাঝে এই যে একটি মাত্র অভাব তাঁকে অত্যন্ত পীড়া দেয়। এমন অভাব পূরণ করা তাঁর কাছে কোন সমস্যাই নয়। মাঝে মাঝে ভাবেন কিন্তু এ পথ থেকে বিরত রাখবার আসল তথ্যটি ব্যক্ত করতে পারেন না। এটা তার দুর্বলতা- না সঙ্কোচবোধ তা তিনি নিজেই স্থির করতে পারেন না। দেড় বছরের মেয়ে ফৌজিয়াকে নিয়ে পাশের ঘরে শুয়ে আছে তাঁর বন্ধু স্ত্রী লাবনী। মাত্র এক সন্তানের জননী। সুন্দরী মেয়ে লাবনী। যৌবনের পূর্ণতা তার দেহ মনে বিরাজমান। নিজেকে নিয়ে সে কি কিছু ভাবে না! এমন একটা পরিবারে যে প্রাচুর্যের মধ্যে সে বাস করছে তাতে সঙ্গীহীন জীবন সে সহ্য করতে পারে কি করে। কেবল ফৌজিকে পরিচর্যা ও দেখা শোনার জন্যেই তো রয়েছে মুন্নি। সে এই পরিবারের আপন সদস্যের মত স্থান পেয়েছে ফৌজির জন্মের আগে থেকে। কিন্তু নিজ কার্য সম্পাদন করবার সময়টুকু ব্যতীত আর একদণ্ডও লাবনী তাকে কারও কাছে দিতে চায় না। অথচ সেদিকে তার না চাইলেও কোন অসুবিধা নাই। নিজের পেটের ছেলে আদেলের দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ সে একটুও পায় না। সময়ের সবটুকু তার কেটে যায় ফৌজিকে নিয়ে। সে ভেবে নিয়েছে উভয়ের শূন্য স্থানটা উভয়কে দিয়েই পূরণ করবার। পূর্বের মতই তো তাদের কথা বার্তা, খাওয়া দাওয়া উঠাবসা মেলামেশা চলছে। একটি দিক বাদে আমার আরাম আয়েশের সব উপকরণ সে নিজ হাতেই জোগান দিয়ে যায়। এর জন্যে আলাদা কাজের মেয়ে আছে কিন্তু আমার বিষয়ে তার কিছু করবার সুযোগই নেই, লাবনী হুঁশিয়ার মেয়ে। সেই সুযোগ তাকে পেতে দেয় না। কোন দিন দুর্বল মুহূর্তেও আকারে প্রকারে প্রকাশ করেনি আমার পাশে শূন্য শয্যায় সে স্থান পেতে চায়। সে চাইলে আমি তাকে নিরাশ করব না। তবে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কোন পদক্ষেপ নেব না।
বাইরে বাতাসের বেগ কমে এসেছে। বৃষ্টি ঝরছে গুড়ি গুড়ি। ভাসমান মেঘের ফাঁক গলিয়ে চাদের আলো জানালা ভেদ করে তাঁর সামনের টেবিলে এসে লুকোচুরী খেলছে। হাশিম খান একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে একবার পাশে শূন্য শয্যার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। আহ্ এমন সময় যদি নার্গিস বেগম থাকতো তাঁর পাশে। সে নেই যুগ যুগ ধরে এমনিই ভাবে যদি চেয়ারে বসে টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে তার আগমনের প্রতীক্ষায় থাকি তবু সে কোন দিন আর ফিরে আসবে না। সেকী কোন দিন স্বপ্নে দেখেছিল যৌবনের প্রারম্ভেই তাকে দুনিয়া ছাড়তে হবে। স্বামীহারা লাবনীর আর তো অভাব ছিল না। তবু সে কেন তাকে আপন করে নিয়ে এলো তার পাশে। স্বামীর শোক তাকে এক মুহূর্তও পেতে দেয়নি। তার মনোরঞ্জনের জন্যে যা করবার তা সবই সে করেছে। শেষ বেলায় তার নিজের আসনে তাকে বসবার মিনতি জানিয়ে গেছে। ধনী কন্যা নার্গিস বেগম প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হয়েও এক তিল পরিমাণ গর্ব অহংকার তার ছিল না। সে ছিল মহৎ। হৃদয় ছিল তার উদার। তাই স্বামী আর মেয়েকে সোপর্দ করে গেল বন্ধুর স্ত্রী লাবনীর হাতে। সে বুঝেছিল উভয়ে ছিটকে পড়বে দু’দিকে। জীবনটা উপভোগ করবার আগেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে আমাদের হৃদয়াকাশ। তাই এক সূত্রে গেঁথে রাখবার পথ তৈরী করে গেল। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও সেই ফুল তেমনই রয়ে গেল। পরস্পর যুক্ত হয়ে- মালা গাঁথবার জন্যে কেউ এগিয়ে এল না। একী সঙ্কোচ, না লজ্জা, না অন্য কিছু!
হাশিম সাহেব!
তার কক্ষের ভেজালো দরজা ঠেলে কে যেন নি:শব্দে ঘরে ঢুকলো। ডাকলো তাঁর নাম ধরে। এ ডাক অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ছিল ক্ষীণ। হাশিম সাহেবকে কল্পনার জগত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। আরও যেন বার কয়েক ডাকলো, কোন সাড়া না পেয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পিছন থেকে তাঁর দু’কাঁধে হাত রেখে আবার ডাকলো- হাশিম সাহেব!
চমকে পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন- কে?
কোন উত্তর পেলেন না। অথচ তাঁর দু’কাধে তখনও কোমল হাতের স্পর্শ লেগে আছে। ঘরে আলো জ্বলছেনা, কেবল সামনের খোলা জানালা না দিয়ে বাইরে আবছা আলো এসে পড়েছে। এই আলোয় ঘরের মধ্যে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কেবল ছায়ার মত মনে হচ্ছে। ছায়া মূর্তিকে স্পষ্ট বুঝতে পারলেন না। নার্গিস বেগমের অশরীর ছায়া মূর্তি! সেকি তাঁর নি:সঙ্গ জীবনের দীর্ঘ নি:শ্বাস শুনে শুনে আর স্থির থাকতে পারলে না! আমি একি ভাবছি! এসব অবাস্তব কল্পনা কেন আমার মাথার মধ্যে ভিড় করছে। এক মুহূর্তের জন্যেও তার ছায়া এই বাস্তব পৃথিবীতে দেখা যেতে পারে না, তবে কে আমার কাঁধে হাত রেখে পিছে দাড়িয়ে আছে! হাশিম সাহেবের মনে হল পিছনে দাড়ানো মূর্তিটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। তিনি একবার মনে করলেন তার একখানা হাত ধরে টেনে সামনে এনে দেখে নিই কে এলো তার শোবার ঘরে। কিন্তু তাঁর হাত উঠলো না, মুখে কোন কথাও ফুটলো না। তার মেরুদণ্ড আর সোজা হয়ে থাকতে পারলোনা, মাথাটা নুইয়ে এলো। তিনি কি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন! তাঁর অচৈতন্য দেহ যেন একদিকে কাঁৎ হয়ে পড়ছে। এরপর তিনি আর জানেননা তাঁর কি হয়েছিল।
ছায়ামূর্তিটি যখন বুঝলো হাশিম সাহেব চেয়ার থেকে নিচের দিকে ঝুড়ে পড়ছেন তখন স্ববলে তাঁকে পাজাকোলা করে পাশের বিছানার উপর শুইয়ে দিল। এক পাশে বসে তার কোমল ডান হাতখানি দিয়ে মাথা ভর্তি কালো চুলের মধ্যে বিলি কাটতে লাগল। যখন বুঝলো হাশিম সাহেবের শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এসেছে তখন আস্তে আস্তে উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তখন শয্যার উপর শায়িত ব্যক্তিটি গভীর ঘুমে অচেতন। অনেক সময় গড়িয়ে গেল। টেবিলের পাশে টিপায়ের উপর টেলিফোন বেজে উঠলো। তখনই লাবনী এসে ধরলো, হ্যাঁলো!
কে ভাবী?
চমকে উঠলো লাবনী। অস্পষ্ট স্বরে বললো- আমি তো ভাবী নই।
তবে?
আমি হাশিমের বন্ধু!
সে কি কথা- আপনি লাবনী নন?
হ্যাঁ, কেন?
আমি তো জানতাম-
কথা শেষ করতে না দিয়েই লাবনী বললো- আপনি ভুল জেনেছেন।
অবাক করলেন আমাকে!
আমি তো এমন কোন কথা বলিনি, যা শুনে আপনি অবাক হতে পারেন? আর কিছু বলার আছে?
হাশিম সাহেবকে ডেকে দিন।
তিনি ঘুমিয়ে আছেন, তাকে এখন বিরক্ত করতে পারব না।
সে কি! এতো বেলাবধি তিনি তো ঘুমান না! অফিসে ডায়াল করলে তার পি.এস বললেন, তিনি এখনও আসেননি। বাসায় খোজ নিন। তাকে যে এখনই দরকার!
আপনি কে?
ইউসুফ।
উনি জেগে উঠলে আপনার কথা বলবো।
জাপানের এক ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল আসছেন এগারটার ফ্লাইটে। তাদেরকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসতে হবে। হাশিম ভাই সমিতির সভাপতি। উনাকে তো অবশ্যই থাকতে হবে। এখন দশটা বাজতে গেল অথচ তিনি এখনও ঘুমিয়ে আছেন এ কেমন কথা!
আপনি তো সম্পাদক। আর সদস্যদের নিয়েও তো যেতে পারেন।
কিন্তু সভাপতি সাহেবকে রেখে আমরা যাব, তাকে না পেলে ডেলিগেটরা কি ভাববেন!
বলবেন- অসুস্থ তাই আসতে পারেনি, পরে সাক্ষাৎ হবে।
এ অসম্ভব! উনি ঘুমিয়ে রয়েছেন আর আমি বলব অসুস্থ! দয়া করে আপনি ডেকে দিন।
মাফ করবেন, আমি ডাকতে পারব না।
তাহলে আমি আসি?
আসতে পারেন।
উনি জেগে উঠলে প্রস্তুত হতে বলবেন, আমি আসছি।
লাবনীর হঠাৎ খেয়াল হল ইউসুফ সাহেব এসে ডেকে তুললে সেতো বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন রাখতে পারে, এতো বেলা হয়ে গেছে অথচ কেউ আমাকে ডেকে দিলেনা কেন? দীর্ঘদিন ধরে এই শয্যায় শয়ন করিনি। শূন্য শয্যা খা খা করত। আজ