Discover millions of ebooks, audiobooks, and so much more with a free trial

Only $11.99/month after trial. Cancel anytime.

Purano Rasta Notun Parapar: a novel
Purano Rasta Notun Parapar: a novel
Purano Rasta Notun Parapar: a novel
Ebook562 pages4 hours

Purano Rasta Notun Parapar: a novel

Rating: 0 out of 5 stars

()

Read preview

About this ebook

Malek and Priya are brother and sister, very different from each other except for their determination to succeed. They are part of a Bengali joint family founded by their father, the rational but trusting Shams. Malek abandons school and takes to business. He falls in love with a beautiful widow, much older than he is. Priya had to marry a college professor who opposes her pursuit of education and singing. Spanning four decades when their homeland changes from Bengal to East Pakistan, then through the Liberation War to Bangladesh, they struggle to build their lives.
The shift of people from village to provincial town to capital city as the country develops is a cause of the split up of the extended family into nuclear families. Shams sees education as the medium by which his family can prosper. His belief is undermined by Malek’s bid for freedom from schooling, and by the warped and cruel character of his highly educated son-in-law. The mother and the eldest daughter-in-law in the family, traditional souls, are contrasted with daughter Priya and other daughter-in-laws who would like more education, respect and jobs outside the home. While overall, the setting is of a middle class Muslim South Asian family with none of the religious angst of extremism, we do have a glimpse of the sectarian violence post-partition and the notorious train massacres, in which a brother is nearly a victim but in fact the comedic treatment gives us a light hearted moment. Dictatorships and unequal power distribution in the two wings of Pakistan, are touched on, while the fear and disruption of the 1971 Liberation War are dealt with in more detail.
From comments by a professional reader through Indepenpress: …The story is written in an understated, straightforward, yet lyrical style, creating a strong sense of a Bengali Muslim community through its vivid descriptions of the local landscape of Rajshahi, of food and cooking, homes and transport. …..
Fabia Claridge, Sydney, Australia, novelist and political activist…. fantastic book! Loved it and wanted to keep reading to find out what happened to the characters. It took me right back to 'old' Bangladesh. I really got involved in the people's lives. It was a very clever and detailed picture of joint family life and the social change that occurred bringing about the nuclear families. ….. (The book) brought back a wonderful time and place that may already have passed.
From a review by Eshanul Haque, ex-lecturer of English in Dhaka University, ex-defence secretary of Bangladesh, now working as a translator in the USA.…flashes of excitement when the children go on bird hunting expeditions or have a game of carrom at a forbidden hour and the grim consequences that follow, or the pranks they play upon unsuspecting street vendors. ……Characters are deftly drawn. Surprisingly one of the least likeable characters, Barek, Priya’s jealous and possessive husband comes out as a truly authentic figure. Malek, on the other hand, is pugnacious and bit of a bully but honest and hardworking..
Review by Gaye Hicyilmaz, YA novelist and reviewer. Dr Rahman’s first novel reminds me of a water colour: for it has all the charm and delicacy of that medium. It lingers in the mind. ….It’s a story that we all recognise. There are no violent colours or clashing contrasts demanding attention, although the author deals with immensely serious and difficult topics: domestic violence, civil war and religious intolerance. ..... And it’s a novel that I cannot recommend highly enough because it’s that unusual creation, a picture that delights and informs and says so much more through its skilful simplicity than many tub thumping pages ever achieve.
LanguageBengali
Release dateMar 26, 2015
ISBN9781783016297
Purano Rasta Notun Parapar: a novel

Reviews for Purano Rasta Notun Parapar

Rating: 0 out of 5 stars
0 ratings

0 ratings0 reviews

What did you think?

Tap to rate

Review must be at least 10 words

    Book preview

    Purano Rasta Notun Parapar - Shelley Rahman

    পরিচিতি

    পুরনো রাস্তা নতুন পারাপার

    ১ নিঃসঙ্গ আনিসা

    লম্বা পুকুরটি বিস্তৃত হয়ে একেবারে পুবমুখী বাড়িটির সম্মুখ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। ওই বাড়ির ব্যালকনি থেকে পুকুরের চারপাশের প্রায় সব রাস্তা পরিষ্কার দেখা যায়। অথচ আনিসা যখন সেখানে বসে রাস্তাগুলোর প্রতি চেয়ে থাকে তখন তাকে কেউ খুব একটা দেখতে পায় না। দুই বছর আগে বিধবা হয়েছে আনিসা। তার বাচ্চাদের বড় তিনজন স্কুলে গেলে সে প্রায়ই এখানে বসে পাড়ার কর্মকান্ড লক্ষ করে ও দৃশ্যগুলো উপভোগ করে। কখনো কখনো সে নিজেকে ডিটেক্টিভ বলে মনে করে হেসে ওঠে। কোন পড়শি কোন সময়ে কার বাড়ি যায়, কে কখন বাজার থেকে ফেরে কুলির মাথায় বোঝা চাপিয়ে পায়ে দলে বা রিকশা করে। অথবা কুলির ঝাঁকাটি রিকশার পাদানিতে রেখে কুলিকে পাদানির একপাশে বসিয়ে, তা সে খেয়াল করে। সে অতীতে এও লক্ষ করেছে যে তার প্রতিবেশী শামস রহমান কুলিকে পাদানিতে নয়, সব সময় একেবারে তার নিজের পাশে বসিয়ে বাজার থেকে ফিরত। সে ভাবত শামস একজন উদারমনা ব্যক্তি। তবে আজকাল আর শামস নিজে খুব একটা বাজার করে না। তার মেজো ছেলে মালেক রহমান করে।

    অন্যান্য দিনের মতো আজও সে ব্যালকনির রোদে গিয়ে বসে। তার লম্বা ঘন চুলগুলো পিঠের ওপর মেলে দিয়ে। পুকুরটির ওপর দিয়ে বয়ে আসা হালকা বাতাস সে উপভোগ করছে। আজ আনিসা ফেরিওয়ালাদের তৎপরতা দেখছিল। প্রথমে তার দৃষ্টি হামিদ মিয়ার বাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হলো। সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সেখানে সাইকেলের মতো একটি মেশিনের সিটে বসে প্যাডেল ঘুরিয়ে এক ফেরিওয়ালা তাদের বাড়ির যতসব ছুরি-কাঁচি ধার দিচ্ছে। অন্য একটি বাড়ির সামনে একজন ঝাঁকা মাথায় চিৎকার করে বলছে, মাছ নিবেন, মাছ। টাটকা মাছ। এবার আনিসার দৃষ্টি দুটি গরুগাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হলো। বস্তা বোঝাই গাড়ি দুটি পুকুরের উত্তর পাশে অবস্থিত শামসের বাড়ির সামনে এসে থামল। কিছুক্ষণ পর মালেক বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। পরনে একটি সাদা স্যান্ডোগেঞ্জি ও লুঙ্গি। তার যোদ্ধার মতো প্রশস্ত বক্ষ ও ঘাড় দেখিয়ে। আনিসার মনে পড়ল, মালেক অল্পক্ষণ আগে সাইকেলে করে বাড়ি ফিরেছে। সাইকেলের হ্যান্ডেলের সঙ্গে একটি চটের স্ফিত ব্যাগ ঝুলানো ছিল। দেখে মনে হলো ব্যাগভর্তি বাজার। মালেক সাধারণত এই সময় বাজার করে ফিরে। আজ যখন ফিরল তখন তার পরনে শার্ট ও প্যান্ট ছিল। আহা, বেচারা! সাইকেল চালিয়ে হয়তো ঘেমে গেছে। মালেক বেরিয়ে এসে সরাসরি গাড়ির চালকদের কিছু বলল। আর গাড়ির চালক ও তাদের সহকারীরা হয়ে উঠল তৎপর। আনিসা এই কর্মতৎপরতা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না। সাহায্যকারী ছেলেরা গাড়ি থেকে একটি করে বস্তা পিঠে নিয়ে মালেকের পিছু পিছু বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। বস্তাগুলো পিঠে তুলে নেওয়ার সময় গাড়োয়ানরা ছেলেদের সাহায্য করল। এগুলো নিশ্চয়ই ভারী। হয়তো সেজন্য ছেলেরা সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটছিল। কাছে থাকলে হয়তো এদের থপ থপ করে পা ফেলার শব্দ আনিসা শুনতে পেত। সে বুঝতে পারছে না বস্তাগুলোতে কী থাকতে পারে। সাহায্যকারীরা যখন পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরে এসে গাড়িতে উঠে বসল মালেক তখন গাড়ির চালকদের কী যেন দিল। মনে হলো তাদের পাওনা। আনিসা লক্ষ করেছিল যে অধিকাংশ বস্তার বাইরে অনেক জায়গায় থ্যাবড়া থ্যাবড়া কালো দাগ। সে কৌতূহলী হয়ে উঠল। ভাবল যখন মালেক তার বাড়ির সামনে দিয়ে যাবে তখন তাকে জিজ্ঞেস করবে বস্তাগুলোর মধ্যে কী ছিল। মালেক তো প্রায়ই তার বাড়ির সামনে দিয়ে বিকেলে মোড়ের দিকে যায়। কিন্তু তার এত উৎসাহ দেখানো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না।

    এগুলো দেখতে দেখতে আনিসার প্রায় পুরো সকালটিই চলে গেল। তবুও ব্যালকনি ছেড়ে উঠতে তার মন চাইল না। একসময়ে সে ভাবতে থাকে যে তার একার পক্ষে সংসার চালানো দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, ওদের বিভিন্ন ধরনের চাহিদা বাড়ছে। ছোট দুটি মেয়ে এখনো স্কুল শুরু করে নি। ওরা অন্য ঘরে আয়ার সঙ্গে খেলছে। অর্থের আধিক্য তার না থাকলেও খুব টানাটানি তার কোনোদিনই ছিল না। তবে বিধবা হওয়ার পর থেকে তাকে বিলাসসামগ্রীর খাতে ব্যয় সীমিত করতে হয়েছে। স্বামী আজাদ খন্দকারের মৃত্যুর পর মৃতদেহের সৎকারের খরচ বহন ও তার ধার-দেনা পরিশোধ করে বাকি যে নগদ টাকাপয়সা ছিল সেগুলো তার চার ভাই ভাগ করে নিয়েছে। আনিসা ও পাঁচ ছেলেমেয়ের ভাগে পড়ল এ দোতলা বাড়ি, আর লক্ষ্মীপুরের জমিগুলোর অংশবিশেষ। বিয়ের পর পরই অবশ্য আজাদ তাকে পুরনো প্রথা অনুসারে পানসুপারির খরচের জন্য বেশ কয়েক হাজার টাকা দিয়েছিল। ওই টাকা সে আলাদা করে রেখে দিয়েছিল দুঃসময়ের জন্য। সে টাকায় সে হাত কখনো দেয় নি। সে কথা আজও সে বলে নি কাউকে।

    তাদের বাড়ির নিচতলার ভাড়া থেকে দৈনিক বাজারহাট ও বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ চলে। তবে বাচ্চাদের অসুখবিসুখ হলে একটু সমস্যা হতো। সেজো ছেলে সাজিব ছোটবেলায় পোলিও মায়ালাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়। ফলে সে খুঁড়িয়ে হাঁটে। তার যাতায়াতের জন্য মাঝে মাঝে রিকশাভাড়া দিতে হয়। সে জন্য কিছু টাকা তাকে সব সময় মজুত রাখতে হতো। আর ঈদের কাপড়চোপড় তো একটা আলাদা ব্যয়বহুল খাত। এ ছাড়া তার নিজস্ব একটা খরচ আছে না ? আনিসার ছোটবেলা থেকেই প্রসাধনীর প্রতি একটু দুর্বলতা ছিল। লক্ষ্মীপুরের জমির ফসল বিক্রির টাকা আসার জন্য স্বচ্ছলতার সঙ্গে তার চলে যায়। তা না হলে জীবনের ন্যূনতম বিলাসিতা থেকে বঞ্চিত হতে হতো অথবা জমা টাকায় হাত দিতে হতো।

    এ ছাড়া বাড়িতে পুরুষমানুষের অবর্তমানে বাচ্চাদের মানসিক সব প্রয়োজনগুলো সে একা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে বলে মনে করে না। বাচ্চারা তাদের পিতার অনুপস্থিতি অনুভব করে। ওরা যখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি, মারামারি করে আর আনিসা যখন সে হট্টগোল একেবারেই সহ্য করতে পারে না, অন্তত তখন সে তার স্বামীর অনুপস্থিতি অনুভব করে।

    স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক অনেক দিন চলে গেলেও সে সারা দিন কোনো সমবয়সী মানুষের সঙ্গ পায় না। কারও সঙ্গে কোনো কিছু নিয়ে একটু গভীরভাবে আলোচনা করবে সে সুযোগ হয় না। অবশ্য তার স্বামী বেঁচে থাকতে যে খুব একটা হতো তাও নয়। বাচ্চাদের সঙ্গে থাকা, ওদের সঙ্গে কথা বলা, এতে তার অফুরন্ত তৃপ্তি আসে। কিন্তু বড়দের সঙ্গের অভাবটি মাঝে মাঝে এত তীব্র আকার ধারণ করে যে তার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ওই নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোতে সে মনে করে বোধহয় সারা জীবন এভাবে একাকী কাটানো সম্ভব নয়। তার জীবনে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন। তার বয়স তো খুব একটা বেশি নয়। এই বয়সেও তো অনেকে মা হয়। তা ছাড়া নিরাপত্তার একটি প্রশ্ন আছে না ? একা একা এ-বাড়ি ও-বাড়ি যাওয়া সে পছন্দ করে না। যখন বাধ্য হয়ে বাইরে বেরোতে হয়, তখন রাস্তার লোকজন এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন মনে হয় যে ওদের দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে। এতে তার খুব অস্বস্তি লাগে। সেজন্য আজকাল আর সে খুব একটা বের হয় না। যখন আর কোনো উপায় থাকে না, হয়তো লৌকিকতার চাপে এখানে ওখানে যেতে হয়, তখন সে কালো বোরকা পরে স্বস্তি পায়। কিন্তু এভাবে তো বাকি জীবন কাটানো সহজ নয়।

    ভাবি, একজন মহিলা এসেছেন বেড়াতে। উনি আরেকদিন এসেছিলেন।

    কাজের মেয়েটি এসে ঘোষণা করল। আনিসা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ভাবল, সে যেই হোক না কেন, অন্তত কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে।

    আসতে বল।

    আনিসা দেখল যে তারই এক প্রতিবেশী মাসুমা এসেছে।

    তারা দুজনে গল্প করল, পাড়ার দু-একজন মানুষ নিয়ে খুব হাসিঠাট্টা করল। চা খেল। পরে একসময় মাসুমা বলল, ভাই সাহেবের মৃত্যুর তো প্রায় দু’ বছর হয়ে গেল। আর কত দিন এভাবে একা একা থাকবে ? একটি গৃহকর্তার তো প্রয়োজন আছে। এ নিয়ে কিছু ভাবছ ?

    তেমন কিছু না।

    আমার ছোটভাই থাকে হড়গ্রামে। তার পাশের বাড়িতে থাকেন একজন উকিল, হাসান আলী। ওঁর স্ত্রী নাকি এক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন।

    হায়! হায়! কীভাবে মারা গেলেন ভদ্রমহিলা ?

    কলেরা হয়েছিল।

    কলেরা হয়েছিল ? এই রোগ তো একটু সচেতন হলে এড়ানো যায়।

    ওদের কপাল খারাপ। সে যাই হোক, মি. আলী আবার বিয়ে করতে চান। ভদ্রলোক দেখতে চমৎকার। কথাবার্তায় অমায়িক।

    ভদ্রমহিলার কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়েছিল ?

    হয়েছিল। তাদের চারজন বাচ্চা। তিন ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটি সব চেয়ে বড়। বিয়ের বয়সী। ওরা বর খুঁজছে।

    আপা, আমার নিজের তো পাঁচ ছেলেমেয়ে। তার ওপরে আরও চারজন। আপনি কি মনে করেন না সেটা আমার জন্য একটু বেশি হবে ? তো ভদ্রলোকের বয়স কত ?

    এই পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে। তবে উনাকে দেখলে এত বয়স বোঝা যায় না। মনে হয় চল্লিশের কাছাকাছি।

    বুঝলাম। তবে আমার চেয়ে পনেরো-বিশ বছরের বড়, চার ছেলেমেয়ের বাবা। না, এ ধরনের পুরুষ আমার প্রয়োজন নেই। ওই বয়সের পুরুষের সঙ্গে আমার জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে। এবার জীবনটাকে একটু অন্যভাবে সাজাতে চাই। দেখা যাক কপাল কোথায় নিয়ে যায়!

    ভদ্রলোক কিন্তু খুব আকর্ষণীয়। আচার ব্যবহারে নিখুঁত। রুচিবান, অর্থশালী।

    হতে পারে। উনি নিশ্চয়ই অন্য কারও জন্য চমৎকার একজন বর হবেন।

    বুঝলাম। তবে আরও একটু চিন্তে করে দেখো।

    তারপর এক আঙুল দিয়ে আনিসার শরীরে মৃদু গুঁতা দিয়ে বলল, এত রূপ নিয়ে একা একা থাকাও নিরাপদ নয়। আচ্ছা, আজ তাহলে উঠি।

    জি আপা। গল্প করে খুব ভালো লাগল। একা একা থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে দরজা পর্যন্ত গিয়ে মাসুমাকে বিদায় দেওয়ার সময় আনিসা বলল, আবার আসবেন আপা।

    মাসুমা চলে যাওয়ার পর আবার ব্যালকনিতে শূন্যতা। আনিসা ধীরে ধীরে এল ব্যালকনির ধারে, সামনের রেলিঙের কাছে। রেলিঙের ওপর দুই বাহুর কনুই রাখল ও হাতের তালুতে তার থুতনি। সামনের দিকে ঝুঁকে অলসভাবে চেয়ে রইল। পুকুরটির একটি মাত্র ঘাট। সেটি আনিসার বাড়িরই সামনে, রাস্তার ওপারে। এই মুহূর্তে ঘাট জমজমাট হয়ে আছে। বাচ্চা, বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা সবাই উৎসাহের সঙ্গে স্নান করছে, সাঁতার কাটছে, কাপড় ধুচ্ছে, গল্প করছে। বাচ্চারা পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে। চিৎকার করছে। ঘাটে কত আনন্দ-ফুর্তি, কত সাহচর্য। কিন্তু আনিসা একা। একেবারেই একা।

    সপ্তাহ দুই পর। এক সুন্দর জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে আনিসা ব্যালকনিটির এক স্তম্ভে হেলান দিয়ে পুকুরের দিকে আনমনে চেয়ে আছে। বেনি বাঁধা চুল। বেনিটি ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে বুকের মাঝখানে ঝুলিয়ে রেখেছে। হাত দুটি তার কোমরের পেছনে। রাস্তাঘাটে মানুষজনের সংখ্যা কমে গিয়ে নীরব হয়ে গেছে সারা অঞ্চলটি। মবিনুর রহমান বছর চার-পাঁচেক আগে পুকুরটি খনন করে তার গভীরতা বৃদ্ধি করে। আর উঠানো মাটি পুকুরটির চারপাশে জমা করে। এই তোলা মাটিতে সে ঢাকার প্রসিদ্ধ সাগরকলা গাছ লাগায়। গাছগুলো বড় হয়ে গেছে এবং দু-তিনটি গাছে কলার কাঁদিও ইতিমধ্যে এসে গেছে। আনিসা লক্ষ করে যে কলাগাছের লম্বা লম্বা পাতাগুলো মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছিল। পানির নিকটবর্তী গাছগুলোর পাতা জ্যোৎস্নার আলোতে প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল সেই পুকুরের জলে। ঝিরিঝিরি ঢেউয়ে রুপালি চাঁদের প্রতিবিম্বও তখন কুচকে কুচকে উঠছিল। সবকিছু মিলে সৃষ্টি হয়েছিল এক তুলনাহীন মায়াজাল।

    কেমন আছ আপা ?

    আরে, আরে, মঞ্জু! তুই কখন এলি ? হঠাৎ ? আমাকে একেবারে চমকে দিয়েছিস।

    এই তো, এখনি।

    মঞ্জু আনিসার ছোটভাই। আনিসা বলে, কোথা থেকে আচমকা এসে হাজির হলি ? আগেভাগে তো জানাতে হয়। সব খবর ভালো তো ?

    আব্বার শরীর ভালো যাচ্ছে না।

    কেন, কী হলো ?

    হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মা তোমাদের নিয়ে যেতে বলেছেন। সবাইকে সঙ্গে করে কালই যেতে চাই।

    সত্যি করে বল দেখি, আব্বার শরীর কেমন ?

    বেশি ভালো না। ডাক্তার বলেছে আত্মীয়স্বজনদের সংবাদ দিতে। এসে যেন দেখা করে যায়।

    মঞ্জুর গলা ধরে গেল। সে আরও বলে, আব্বা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। এখন জ্ঞান ফিরেছে তবে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলেন।

    আনিসা এ লক্ষণগুলির সঙ্গে পরিচিত। শুনেছে, আজাদেরও নাকি তাই হয়েছিল। এর পরিণতি কি হতে পারে তা চিন্তা করে শিউরে উঠল। বলল, যাই তাড়াহুড়া করে কিছু গোছগাছ করে নিই। তুই খেয়েছিস ? এই সামেলা, মঞ্জুকে খেতে দে।

    আনিসা ছেলেমেয়েসহ মঞ্জুর সঙ্গে দেশের বাড়ি পৌঁছে দেখে যে তাদের বাবা আবার জ্ঞান হারিয়েছে। বাবাকে ফরিদপুরের সদর হাসপাতালে পুনরায় নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু কাজ হলো না। দুদিন পরে সে ইন্তেকাল করল। সারা পরিবারের ওপর নেমে এল বিষাদের মেঘ। আনিসার মা প্রায় নির্বাক। আনিসা সিদ্ধান্ত নিল যে তারা আরও কয়েকদিন থাকবে। কুলখানি পর্যন্ত। মঞ্জু ও তার অন্যান্য ভাইয়েরা সবাই কুলখানির আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

    কুলখানির দিন পর্যন্ত আনিসার মা মোটামুটি সারাক্ষণ একাকী নিজের ঘরে অবস্থান করে কোরআন শরিফ পাঠ করে। কারও সঙ্গে খুব একটা কথা বলে নি। কুলখানির পরের দিন আনিসা তার মাকে যখন বলে যে তারা এখন রাজশাহী ফিরতে চায় তখন সে আনিসাকে বলল, তোর বাবা মৃত্যুর আগে বলছিল, তুই যেন আবার বিয়ে করিস।

    হ্যাঁ মা। মাঝে মাঝে আমিও ভাবি কথাটা। তা ছাড়া বাচ্চাদেরও একটি বাবার প্রয়োজন।

    তোর বাবা সৈয়দ সরোজ ফরিদি নামে একজন জমিদারকে বিশেষভাবে চিনতো। কিছুদিন আগে তার স্ত্রী মারা যায়। ভদ্রলোক নাকি খুব চমৎকার।

    ভদ্রলোক কোথায় থাকেন ?

    ফরিদপুর অঞ্চলেই থাকে। আজাদের বয়সী অথবা তার চেয়ে সামান্য একটু বড় হবে। এর সঙ্গে তোর বিয়ে হোক এটি তোর বাবার একান্ত ইচ্ছা। কথাটা বেচারা তোকে জানিয়ে যেতে পারে নি।

    মা, বাবা কেবলই ইন্তেকাল করেছেন। আর কিছুদিন যাক তারপর না হয় এ সমন্ধে আলোচনা করব।

    এটা তোর বাবার বিশেষ ইচ্ছে। সরোজকে আমিও দেখেছি। ছেলেটি ভালো। ওকে বিয়ে করলে তোর আর টাকাপয়সার কোনো সমস্যা থাকবে না।

    চল্লিশার পর আপনি রাজশাহী আসেন। তখন এসব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করব। আপনি এলে একটা পরিবর্তনও হবে। আপনার ভালো লাগবে। নাতি নাতনিদের সঙ্গে থাকবেন।

    আপাতত মা, আমার ভিটা ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাচ্ছি না।

    আমাকে অবশ্য যেতে হবে মা, কারণ বাচ্চাদের স্কুল আছে।

    বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরে বিকালে ব্যালকনিতে বসে মা’র সঙ্গে মুড়িমাখা খাচ্ছে। আনিসা অবশ্য সঙ্গে চা-ও খাচ্ছে। স্কুল ও হোম ওয়ার্ক সম্পর্কে কথা শুনছে। সব ছোটটি মা’র কোলে বসে। বিকেলের সূর্য তখন পশ্চিমে বেশ কিছুটা হেলে গেছে। আনিসা হঠাৎ দেখল যে মালেক তার বাসা থেকে বেরিয়ে তার বাড়ির দিকে আসছে। হয়তো রাস্তার মোড়ে যাবে। আবার কিছুক্ষণ পর বাসায় ফিরে যায়। আনিসার সেই আগের কৌতূহলটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ওর জানতে ইচ্ছে হলো অতগুলো বস্তাভর্তি কী জিনিস সেদিন মালেকের বাসায় উঠাল। আবার গতকাল সে দেখল যে ছয় বস্তা জিনিস বাড়ি থেকে বের করে গরুগাড়ি করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হলো। মালেক কি নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করল ?

    কিন্তু কেমন করে সে মালেককে ডেকে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসবে ? প্রথমত, সে একজন বিধবা আর মালেক একজন অনাত্মীয় সোমত্ত পুরুষ। মানুষ দেখলে কথা বলবে। নিন্দা করবে। কুৎসা রটনা করবে। না, সে এটি করতে পারে না। তার কাজে-কর্মে পূর্বপুরুষের সৈয়দ বংশের দুর্নাম হোক, এটি সে কখনই চাইতে পারে না। কী প্রয়োজন তার জেনে ওই বস্তাগুলোতে কী ছিল? অন্যের বিষয়ে নাক গলানোর তার কোনো দরকার আছে কি ?

    একটু পরেই আনিসা আবার নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করল, মালেক তো আজাদকে ভাই বলে ডাকত। আমাকে সে ভাবি সম্বোধন করে, আমার ছোট দেবরের মতো। মালেকের বাবাকে আমি বাপজান বলে ডাকি। আজাদও তাই ডাকত। একটি বড় পরিবারে যা ঘটে অনেকটা সেইরকম। এই পাড়া তো একটা বিশাল যুক্ত-পরিবারের মতো। যেন একটা বিশাল কাঁঠাল। আলাদা-আলাদা বাড়িগুলো যেন এক একটি কোয়া। সবটি মিলে তো ফল একটিই। আর তা না হলে আজাদের মৃত্যুর সময় প্রতিবেশী মানুষজন এত ছোটাছুটি করত ? এত কি সহায়তা করত ? মালেকও তার সাহয্যের হাত বিভিন্নভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। সে আসলে প্রচন্ড সহযোগী ও বিশ্বাসী। আজাদের মৃতদেহের খাটিয়া যারা বহন করে মসজিদে নিয়ে গেল সে তাদের একজন। তার সঙ্গে কথা বললে কি আর দোষ হবে ? আমি তো আর একা তার সঙ্গে কথা বলছি না। আমার ছেলেমেয়েরা সবাই তো এখন বাড়িতেই। সে বাচ্চাকে সরিয়ে সোজা হয়ে বসল। সে সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়ে গেছে। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কাজের মেয়েটাকে পাঠিয়ে ওকে ডেকে আনবে। কিন্তু ওকে তো এখন সে দেখতে পাচ্ছে না। ও নিশ্চয়ই মোড়ে চলে গেছে। এখনই ফিরবে।

    সত্যি মালেক কিছুক্ষণ পর ফিরে যাচ্ছিল আনিসার বাড়ির সামনে দিয়ে। কাজের মেয়ে সামেলাকে পাঠানো হলো মালেককে ডাকতে। সামেলা দৌড়ে নিচে নেমে গিয়ে মালেককে পেল তাদের বাড়ির সামনেই। বলল, ভাই, ভাবি ডাকতাছে আপনারে।

    মালেক ঠিকমতো বুঝতে না পেরে তাকে প্রশ্ন করে, কোন ভাবি ?

    সামেলা ফ্ল্যাটের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই ওপরতলার ভাবি। বেলাল ভাইয়ার আম্মা।

    হুম! আচ্ছা ঠিক আছে, চলো।

    আনিসার নিচের তলায় ভাড়াটিয়া থাকে। কাজেই বাড়ির ভেতর দিয়ে ওপরতলায় চলাফেরা করার সুন্দর পথটি এখন ব্যবহার করা যায় না। তাদের ও পাশের বাড়ির মাঝ দিয়ে একটি সরু গলি গেছে। তাতে একটা দুর্গন্ধময় উন্মুক্ত নর্দমা আছে। এই পচা নর্দমার পাশ দিয়ে অন্ধকারে প্রায় আচ্ছন্ন সিঁড়ির ঘর পেরিয়ে দোতলায় উঠতে হয়। মালেক ভেতরের বারান্দায় এসেই লক্ষ করল একদম মুখোমুখি বারান্দার শেষ প্রান্তে নামাজের ঘর। হাতের ডানদিকে রেলিং। এই রেলিঙের কাছে দাঁড়ালে বাড়ির ভেতরের আঙিনা দেখা যায়। আঙিনার ওপারে বাড়ির সীমানা ঘোষণা করে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু প্রাচীর এবং তার পরে প্রতিবেশী চৌধুরী সাহেবদের পুকুর। সবুজ পানায় ভরা। পুকুরকে শোভিত করেছে আশপাশের বাড়ির পাতিহাঁসগুলো।

    নামাজের ঘরের দরজা খোলা থাকায় মালেক ভেতরের বারান্দা থেকেই দেখতে পায় যে সেখানে একটি জলচৌকি আছে। তার ওপরে আছে একটি জায়নামাজ। জায়নামাজটি বিছানো। তার ওপরে রেহেলে রাখা একটি বন্ধ করা কোরআনশরিফ। কতখানি পড়া হয়েছে তা নির্দেশ করছে একটি ভাঁজকরা কাগজ। এই ঘরের ভেতরে দরজার পাশে রাখা আছে একটি চেয়ার। আর ঘরের বাইরে বারান্দায় যেখানে মালেক দাঁড়িয়ে আছে সেখানে রাখা আর একটি হাতলবিহীন কাঠের চেয়ার। এটির কাছে ছোট একটি টেবিলও আছে। আনিসা আগেই সামেলাকে বলে রেখেছে যে মালেক এলে তাকে বারান্দার ওই চেয়ারে বসাতে। সামেলা বারান্দার চেয়ার দেখিয়ে বলল, ভাই, এখানে বসেন। আমি ভাবিরে সংবাদ দিই।

    বলে সে আনিসাকে সংবাদ দিতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে ভেতরের দরজা দিয়ে নামাজের ঘরে প্রবেশ করে দরজার আড়ালে রাখা খালি আসনটিতে আনিসা বসল। পর্দা করে মুখামুখি সে বসল না। তবে বসবার সময় আনিসা এক ঝলকে মালেককে দেখে নেয়। সে একটি খাকি ফুল প্যান্টের ওপর বাদামি রঙের ডোরাকাটা হাফহাতা সার্ট পরে আছে। বেশ মানিয়েছে তাকে। আনিসার ওই ঘরে প্রবেশ করার শব্দে মালেক উঠে দাঁড়াল।

    বসো বসো। কেমন আছ ?

    মালেক আনিসাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু তার আকর্ষণীয় কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। ভাবি লজ্জা করে বসে আছে দরজার আড়ালে, ঘোমটা দিয়ে। জবাকুসুম তেলের সুগন্ধ লজ্জা শরমের অবগুণ্ঠন ভেদ করে উপচে পড়ছে বারান্দায়। ঘিরে রেখেছে মালেককে।

    কিছুক্ষণ কুশলাদির আদান-প্রদান। একসময় আনিসা তার কৌতূহলকে আর চেপে রাখতে পারল না। সে জানতে চাইল, গরুর গাড়ি করে বস্তা বোঝাই কী সব জিনিসপত্র সেদিন তোমার বাসায় আনলে ? তারপরে আবার গতকালকে দেখলাম ছয় বস্তা জিনিস বাড়ি থেকে পাঠিয়েও দিলে। তুমি কি নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করলে ?

    হ্যাঁ ভাবি, আমি কয়লার ব্যবসা আরম্ভ করেছি। পাইকারি কিনে খুচরা বিক্রি করছি।

    আপনাকে কে বলল ?

    কেউ না। আমি বারান্দা থেকে দেখলাম। একঘেয়েমি কাটাবার জন্য অনেক সময় আমি সামনের বারান্দায় গিয়ে বসি। তখন পাড়ার অনেক কিছু আমার নজরে পড়ে। তো এ ব্যবসা কেমন চলছে ?

    কেবলই তো শুরু করলাম। এখন দেখা যাক।

    যে কয়েক ব্যাগ বিক্রি করলে তাতে কেমন লাভ হবে বলে মনে হয় ? তুমি কিছু মনে করছ না তো আবার এগুলো জিজ্ঞেস করছি বলে ?

    না ভাবি, আমি খুশি হচ্ছি যে আপনি জানবার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আমার আলাপ করতে ভালো লাগছে। তবে মুনাফা যতটা ভেবেছিলাম ততটা হয়তো হবে না। কাজটি কেবলই শুরু করলাম। দেখি কেমন চলে।

    আমিও তাই বলি। লেগে থাকতে হবে। নিশ্চয়ই ভালো হবে। তুমি মুরগির ডিম পাঠিয়েছিলে, খেলাম। টাটকা ডিমের খুব স্বাদ। আমরা মাঝে মাঝে তোমার কাছ থেকে ডিম কিনতে চাই। হ্যাঁ, সে কারবার কেমন চলছে ?

    কখন লাগবে জানাবেন, ডিম থাকলে অবশ্যই পাঠিয়ে দেব। তা ভাবি, আমার মুরগির খামারটি একেবারেই ছোট। মাত্র চল্লিশটি মোরগ-মুরগি। জায়গার অভাবে খামারটি বড় করতে পারছি না। বিরাট মুনাফার উদ্দেশ্যে এ ব্যবসা ধরি নি। এ উদ্যোগটির আসল কারণ হলো পশুপাখিদের প্রতি বাবার ও আমার উৎসাহ। তবে আশা রাখি, এই কয়লার ব্যবসায় সামনের দিকে এগোতে পারব।

    এমন সময়ে সামেলা একটি ট্রেতে করে দুই কাপ চা ও একটি ডিম পোচ নিয়ে এল। সঙ্গে একটি চা-চামচ ও একগ্লাস পানি। বেতের ট্রেটি মালেকের সামনে রাখা ছোট টেবিলের ওপর রাখল। আর দ্বিতীয় কাপ চা সে আনিসাকে দিয়ে চলে গেল। মালেক চায়ের কাপটি মুখের কাছে আনতে আনতে বলল, এগুলোর আর কী প্রয়োজন ছিল ভাবি! অবশ্য এখন চা খাবারই সময়।

    চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে মালেক বলল, চমৎকার। আমি মোড়ে গিয়েছিলাম চায়ের গুঁড়া কিনতেই। তা ভালোই হলো, আপনার সঙ্গে গল্প করতে করতে খাওয়া যাবে।

    চা খাওয়া শেষ হলে ওরা আরও কিছুক্ষণ গল্প করে। মালেক যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াল। আনিসা বলল, আবার এসো। গল্প করে মনটা ভালো হলো। সারা দিন একেবারেই একা থাকা আর কত ভালো লাগে। কয়লার ব্যবসা কেমন চলছে জানাবে।

    অবশ্যই জানাব, ভাবি। আপনার এত উৎসাহ তা তো জানতাম না। আপনিও আমাদের বাড়ি আসবেন। মুরগির খামার দেখবেন।

    কথাটি বলে মালেক অতর্কিতে আনিসার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে। দরজার চৌকাঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ও। নীল পাড়ের সাদা শাড়ির আঁচল মাথা থেকে ফসকে পড়ে তার লম্বা কালো কোঁকড়ানো চুলগুলো প্রকাশ করল। হাতে কানে কোনো গহনা নেই। অথচ বিকেলের এ মিষ্টি আলোতে তাকে অপূর্ব সুন্দর লাগল।

    হ্যাঁ, আসব।

    মালেক চলে গেল। আনিসা ওর যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইল।

    ২ লাল ইটের সেই বাড়ি

    ছয় বছর আগে। জাপানিরা যদি কলকাতায় বোমা না ফেলত তাহলে শামস রহমান তার বাড়িটি দোতলা করে ফেলত। সে ১৯৪২ সালের কথা। যদিও রাজশাহী কলকাতা থেকে প্রায় এক শ’ মাইল দূরে, শামস তবুও ভয় পেল। ভাবল, কী হবে দোতলা করে। জাপানিরা যদি ব্রিটিশ কলোনি কলকাতায় বোমা ফেলতে সক্ষম হয়, তাহলে শিক্ষার কেন্দ্র রাজশাহীতেও বোমা ফেলতে পারে। অযথা অর্থের অপচয় হবে।

    রাজশাহী শহরের চৌধুরীপাড়া অঞ্চলে এক বিশাল লম্বা পুকুরের পাশে শামস এক টুকরো জমি কিনে রেখেছিল। ওইখানেই সে বাড়িটি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাজশাহীতে আবার দুটো চৌধুরীপাড়া আছে। বড় চৌধুরীপাড়া ও ছোট চৌধুরীপাড়া। তার জমিটি বড় চৌধুরীপাড়ায়, যেখানে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাস অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার বছর তিন আগে শামস রহমান কষ্টকর হাঁপানি রোগের কারণে ডিএসপি-র প্রমোশন প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটিশ পুলিশ সার্ভিস থেকে সিনিয়র পুলিশ ইন্সপেক্টর হিসেবেই অপরিণত বয়সে অবসর গ্রহণ করে এবং রাজশাহী শহরে এই বাড়িটি নির্মাণ করে। শামস বাড়িটি রাজশাহীতে নির্মাণ না করে নাটোরের শস্য শ্যামল মাধনগর গ্রামে পৈতৃক তালুকদার ভিটাতেই করতে পারত। কিন্তু তা সে করে নি। করে নি তার কারণ লেখাপড়ার প্রতি তার সব সময়ই একটা প্রচন্ড আকর্ষণ ছিল। তার ধারণা একমাত্র নিয়মিত স্কুল-কলেজে লেখাপড়ার মাধ্যমেই সুষ্ঠু জ্ঞানার্জন করা সম্ভব। জ্ঞানই মানুষের সুযোগ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে এ কারণেই তার একান্নবর্তী পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধার জন্য উত্তরবঙ্গের শিক্ষার একটি কেন্দ্রস্থল রাজশাহী শহরে এ বাড়িটি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। শহরটি তার মাধনগরে পৈতৃক ভিটার মোটামুটি কাছেই। কাজেই সে ভাবল যে তার ক্ষুদ্র তালুকের ওপর সে সহজেই নজর রাখতে পারবে।

    বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষের দিকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছিল শামস। এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার আগে সে তার নাম শামসুর রহমান তালুকদারকে বদলে নিজে পছন্দ করে আরও আধুনিক শামস রহমান রেখেছিল। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পেলে সে গ্রামের ভিটা ছেড়ে শহরে এসে চাকরি খোঁজা শুরু করে। ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা এবং সাধারণ জ্ঞান তার সেকালের বহু মানুষের চেয়ে বেশি ছিল। ফলে ব্রিটিশ পুলিশে সরাসরি সাব-ইন্সপেক্টরের পদে নিয়োগ পেয়ে গেল। তালুকদার ভিটার সঙ্গে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রায় এক শ’ বিঘা চাষের জমি তার ছিল। এ ছাড়া রহনপুরের কাছে বরেন্দ্র অঞ্চলেও তার কিছু ধানি জমি ছিল। কিন্তু অবসরজীবনেও এ তালুক দেখাশোনার দায়িত্ব তাকে আকর্ষণ করে নি। পরিবর্তে ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনির লেখাপড়ার প্রতি সে মনোনিবেশ করে।

    চৌধুরীপাড়ায় ওই বাড়িটি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিলেও শামসের মনে একটা সন্দেহের সঞ্চার হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছিল। জার্মানরা লন্ডনে বোমা ফেলেছে। জাপানিরা প্রাচ্যে তাদের প্রভাব বিস্তার করবার জন্য যুদ্ধে নেমেছে। পার্ল হারবারে বোমা ফেলে মার্কিনদের টেনে যুদ্ধে নামিয়েছে। শামসের দ্বিধা হলো। যুদ্ধ চলাকালে গৃহনির্মাণের কাজ শুরু করা উচিত হবে কি না। কেউ কেউ তাকে উপদেশও দিল কিছুদিন অপেক্ষা করতে। যুদ্ধ শেষ হলে বাড়ির কাজে হাত দিতে। কিন্তু বাড়ির কাজ পুরাপুরি বন্ধ হোক শামস তা চাইল না। বাড়ির পরিকল্পনা ও নকশা অন্তত তৈরি হোক, সেটা সে চাইল।

    সে সময় বেশির ভাগ শহরে পৌরসভার অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু রাজশাহীতে পৌরসভা তখনই ছিল। এটা ঊনবিংশ শতাব্দীতে সৃষ্টি হয়। তবে অস্তিত্বহীন ছিল স্থপতিরা। কাজেই স্থপতি দিয়ে তৈরি করা গৃহনির্মাণের পরিকল্পনা পৌরসভার অনুমোদনের কোনো রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু শামস দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। বাড়ি তৈরির বিষয়ে সে কোনো প্রকারের ভুলত্রুটি করতে রাজি নয়। লোক-প্রশংসা থেকে জানতে পারে রাজশাহীতে একজন দক্ষ রাজমিস্ত্রি হলো ছোট চৌধুরীপাড়ার কেরামত আলী। সে কেরামত আলীর

    Enjoying the preview?
    Page 1 of 1